হরতাল অবরোধের প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়, শঙ্কিত শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থী
# উচিৎ সহিংসতা বর্জন করা, সহনশীল হওয়া: শিক্ষক
# নেতাদের মতো বিদেশে পড়াই না, অতো টাকা নাই: অভিভাবক
# কখন দুর্ঘটনার শিকার হই বলা যায় না,নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক: শিক্ষার্থী
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: বছরের শেষ সময়ে শুরু হয়েছে স্কুলে স্কুলে নানান পরীক্ষার আমেজ। নারায়ণগঞ্জে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলতি মাস থেকেই শুরু হবে বার্ষিকসহ নানা মূল্যায়ন পরীক্ষা। যা নভেম্বরে শুরু হয়ে ডিসেম্বর অব্দি গড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকরা। পরীক্ষার আগ মুহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ও বন্ধুদের সাথে রুটিন আদান প্রদান ও কোচিং পড়তে যাওয়ার জন্য বের হতে হয়। তাই বছরের এই শেষ সময়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষার্থীদের সারা বছরের পরিশ্রমের পর মেধা মূল্যায়ণ হয় নভেম্বর ও ডিসেম্বর ঘিরে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত, একদিকে বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কঠিন কর্মসূচি দিচ্ছে অন্যদিকে ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নিরাপত্তায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহীনির বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি পুলিশসহ একাধিক সংস্থা। প্রতিটি কর্মসূচির আগেই ভীত থাকে অভিভাবক, এতে চরম উদ্বিগ্ন সন্তানের পরীক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ।
তবে, কিছুটা শঙ্কায় রয়েছে শিক্ষকরাও। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শুরু-শেষ করতে পারবে কিনা। নারায়ণগঞ্জে একাধিক প্রাইমারি ও হাই স্কুল, কলেজ শিক্ষকরা জানান ‘রাজনীতির প্রভাব আশা করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়বে না, যদি কোন শিক্ষার্থী বা অভিভাবক শঙ্কিত থাকে, তাহলে সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।’
এদিকে জেলা শিক্ষা অফিসারের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জে মোট ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৫৬ জন শিক্ষার্থী আছে। এছাড়া পুরো জেলায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি মিলিয়ে মোট ২৯৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৪টি স্কুল, ১০টি স্কুল এন্ড কলেজ, ১০টি কলেজ, ২১টি মাদ্রাসা ও ৩টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বন্দর উপজেলায় ২১টি স্কুল, ৪টি স্কুল এন্ড কলেজ, ২টি কলেজ, ৭টি মাদ্রাসা ও ১টি কারিগরি (মেরিন) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সোনারগাঁও উপজেলায় ৩২টি স্কুল, ৪টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৫টি কলেজ, ১০টি মাদ্রাসা ও ১টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আড়াইহাজার উপজেলায় ২৬টি স্কুল, ৫টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৫টি কলেজ ও ৮টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রূপগঞ্জ উপজেলায় ৩২টি স্কুল, ৭টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৫টি কলেজ, ১৯টি মাদ্রাসা ও ২টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এর বাইরে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করায় নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন।
নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হরমুজ আলী লাইভ নারায়ণগঞ্জকে জানান, কলেজ গুলাতে অনার্স, মাষ্ট্রাস ও উচ্চমাধ্যমিকের নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে। এখন বলা যায় একটা পরীক্ষার সিজন চলছে। কিন্তু এই সময়ে যদি দেশে হরতাল অবরোধ হয়, তাহলে আমাদের পড়াশোনার কার্যক্রম চালানো অসুবিধা হয়ে যাবে। তবে সরকার যেভাবে নির্দেশ দিবে সেভাবে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখবো। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। আগের থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গিয়েছে। অভিভাবকরাও সন্তানদের পাঠাতে চায় না। করোনার সময় যে ক্ষতি হয়েছে, সেই প্রভাব এখনো কেটে উঠেনি।
নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মাহমুদুল ইসলাম ভূঁইয়া লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব গতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছি। সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। বাহিরে কি হচ্ছে না হচ্ছে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আপাতত তেমন কোন শঙ্কা নাই। স্কুলের যে সিফট গুলো আছে, সেগুলো একই নিয়মে চলমান আছে। আমরা আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, বাকিটা সরকারের কাজ তাঁরা সেটা দেখবে। তবুও যদি কোন অভিভাবকদের মধ্যে শঙ্কা থাকে তাহলে বলবো আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
এদিকে ২৪ নং দেওভোগ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুন নেসা লাইভ নারায়ণগঞ্জকে জানান, আমাদের প্রাইমারি শিক্ষা কার্যক্রমে আগের মতোই উপস্থিতি আছে। এবং ক্লাস করতে আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখন পর্যন্ত কোন অভিভাবক আমাদের কাছে কোন শঙ্কা প্রকাশ করেনি। তবে দেশের পরিস্থিতি যদি ভালো থাকে তাহলে আমাদের পরীক্ষা শন্তিপূর্ণ ভাবেই নিবো। পুরো বছর শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করে বার্ষিক পরীক্ষার জন্য, কারণ এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাকে উত্তির্ণ হয়। কিন্তু এই অবস্থায় যদি পরীক্ষাটা না দিতে পারে তাহলে দেখা যায় কারো কারো পরিস্থিতি এমন হয় যে, একেবারে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। আমি মনে করি সকল রাজনৈতিক দল গুলোর উচিৎ, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস দুটো সহিংসতা বর্জন করা, সহনশীল হওয়া।
এদিকে, দেশের অবস্থার নিয়ে জানতে চাইলে ওবায়দুল হক নামে এক অভিভাবক লাইভ নারায়ণগঞ্জকে জানান, আমি আমার বাচ্চার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা আমাদের সন্তানদের এই দেশে পড়াশোনা করাই, রাজনৈতিক নেতাদের মতো বিদেশে পড়াই না; অতো টাকা আমাদের নাই। এই হরতাল অবরোধের কারণে বাচ্চাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। আমার সন্তান ৩ দিন যাবত স্কুলে যেতে পারছে না, কিন্তু সামনেই তার বার্ষিক পরীক্ষা। রাজনীতির কাছে আমরা এক ধরণের জিম্মি হয়ে আছি। আমি চাই এই দেশের রাজনীতি যাতে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে পালন করা হয়। কারণ আমাদের সন্তানরা এই দেশের ভবিষ্যৎ। আমি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের কাছে অনুরোধ জানাবো, স্কুল কলেজে যেতে শিক্ষার্থীদের যাতে কোন সমস্যা না হয় এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা যাতে আপনারা দিতে পারেন।
পায়ে হেটে কাধে ব্যাগ নিয়ে সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন মাহবুবুর রহমান। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোন আতঙ্ক নাই। এই সময়ে আমরা চাই নির্ভিঘ্নে পরীক্ষা গুলো সম্পন্ন হোক। এতে আমরাও শঙ্কা মুক্ত হবো। আমরাও চাই দেশে যাতে কোন অরাজকতা সৃষ্টি না হয়, যাতে পড়াশোনায় কোন সমস্যা না হয়। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।
রাজিয়া সুলতানা মুক্তা নামে আরেক অভিভাবক বলেন, যেভাবে বাস পোড়ানো হচ্ছে, ভয় তো একটু কাজ করেই। স্কুলে আসতে হলে রাস্তা দিয়েই আসতে হবে, তাই যে কোন সময় একটা দূর্ঘটনার ভয় থেকে যায়। আমরা অভিভাবকরা চাই এই সহিংসতা বন্ধ করে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম সুন্দরভাবে চলুক।
নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সিজান মোল্লা লাইভ নারায়ণগঞ্জকে জানায়, হরতাল অবরোধের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা অনেকটা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে বের হতে ভয় লাগে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর জুড়ে আমাদের নির্বচনী পরীক্ষা চলবে, তাই কলেজে আসা আমাদের জন্য খুব জরুরী। আমাদের অনেকেই আতঙ্কে কলেজে আসতেছে না। আমরা চাই সব ঠিকঠাক করা হোক।
কমর আলী হাইস্কুল এন্ড কলেজের ১০ শ্রেনীর শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদাউস হালিমা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনিও। জানতে চাইলে লাইভ নারায়ণগঞ্জের এ প্রতিবেদককে জানান, সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙ্গচুর গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। এই অবস্থায় স্কুলে যেতে একটু শঙ্কিত, কখন কোন দুর্ঘটনার শিকার হই বলা যায় না। যেহেতু পুরো বছর পড়াশোনা করেছি, সামনেই আমাদের পরীক্ষা। এখন যদি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায় বা স্থগিত করে দেয়, তাহলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমরা চাই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। যাতে রাস্তায় আমরা কোন বিপদের সমুক্ষিণ না হই।