বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
মতামতসোশ্যাল মিডিয়া

ত্বকীনামা: তারুণ্যের প্রমিথিউস কিংবা দুর্নিবার ইউলিসিসের গল্প

লেখক: মো. ফাহাদ হোসেন ফাহিম, নধর—দেহী নদীর ঢেউখেলানো জল ওকে ডাকে। স্বচ্ছ নির্মল জলের সুবিশাল সে নদী। ওপারে মেঘ ছুঁয়ে বেড়ে ওঠে অসীম আকাশ পানে। ও চেয়ে থাকে অপলক। নির্মীলিত চোখে চেয়ে দেখে চপলমতি মাছরাঙা পাখিদের পথচলা। রাজহাঁসের মতো সাঁতার কাঁটতে কাঁটতে দূরদূরান্ত থেকে ভেসে আসে জাহাজ। শন শন শন হাওয়ায় উড়ে পাল। ডিঙি নৌকাগুলোর বাওটা দুলে। নৌকাগুলো জিরোয়। নেচে নেচে যখন চলে পালের জাহাজ, তখন ও আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘নদী তোমার নাম কি?’ উচাটন নদী বলে, ‘চিরযৌবনা শীতলক্ষ্যা!’ নদী—ও ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম?’ কিন্তু বলার আগেই ও চলে যায়। অবশ্য যায় না, যেতে হয়। প্রতিদিন লাটিমমাখা বিকেলে এই সময়টাতে ও বই আনতে পাঠাগারে যায়। পাঠাগারে পা রাখতেই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে টেবিলে রাখা রঙ—বেরঙের বইগুলো। তড়িঘড়ি করে আঁধার মিলিয়ে পড়ে আটপৌরে লাইব্রেরির জানালার ফাঁকে। কারণ ও যখন আসে, তখন আঁধার বলে কিছু থাকে না। ও কি তাহলে আলো? হ্যাঁ, ও আলো। লাইব্রেরি ওকে আলো নামে ডাকলেও বাবা মায়ের দেওয়া ভালো নামও ওর আছে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী (৫ অক্টোবর ১৯৯৫—৬ মার্চ ২০১৩)। চিড়যৌবনা শরৎ ঋতুর আশ্বিন মাসের ২০ তারিখে স্যমন্তক—মনি রূপে বাবা, রফিউর রাব্বি ও মা রওনক রেহানার কোল আলোকিত করে বসুমতীর নরম খঁুট স্পর্শ কয়েছিল ত্বকী। মাত্র চার বছর বয়সেই মাউন্ট রয়েল একাডেমিতে পড়ালেখার হাতেখড়ি। শৈশব থেকেই ছিল টিমোথি পেনপোয়েমের মত বিদ্রোহী। পড়াশোনার পাশাপাশি দাবাখেলা, বইপাঠ, কবিতা আবৃত্তি, গানকরা, লেখালেখি ও ছবি আঁকতে ভীষণ ভালো লাগতো ওর। যেমন ছিল সে বিরলপ্রজ মেধাবী, তেমনি ছিল সিসিফাসের মত দুর্বার। দেশের সর্বোচ্চ মান তো বটেই, কোথাও কোথাও অতিক্রম করেছিল সে বিশ্বমানকে। ও ছিল intellectual independence এ প্রত্যয়ী এবং বিশ্বাস করতোrational thinking irrational desire কে—ও জয় করতে পারে। এ লেবেল পরীক্ষায় ওর যে উপলব্ধি ‘পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দরকারটা কী’ ওকে লেখাপড়ার মৌলিক তৎপর্য ও জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তায় উত্তীর্ণ করেছিল। ভালো ফলাফলকে সে অস্বীকার করেনি কিন্তু মর্মগতভাবে তার বিরুদ্ধাচরণ করে লিখেছে, ‘মানবো না এই প্রতিযোগিতা/ বিষম খেলা অসুস্থতা/ স্কুলে কেবল ফাস্টর্ হওয়া/ নয় শেষ কথা।’

Death of a Dream ছোটগল্পের আসিফ চরিত্রের মাধ্যমে অনার্জিত কোনো কিছুতেই যে ওর আগ্রহ নেই সেই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ত্বকী জীবনে যা করেছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে করেছে। লেখাপড়া, সাহিত্যচর্চা, সমাজ, চিন্তা ও মননশীলতায় ত্বকী ছিল ফিনিক্স পাখির মতো। ওর স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হওয়ার। বাবা যখন বললেন, ‘ত্বকী এ লেভেল শেষে দেশের বাইরে চলে যাও। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসো।’ ও বাইরে যেতে চাইলনা। বলল ‘দেশের লেখাপড়া কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে?’ দেশকে কতটা ভালোবাসলে একজন কিশোর ছেলে ও কথা বলতে পারে!

মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’ কিংবা তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’, ও লেভেলে থাকাকালীন orientalism এর পাঠ, জাক দেরিদা, প্লেটো কিংবা আইনস্টাইনকে বুঝতে চাওয়া তাঁর একনিষ্ঠ, অনুসন্ধিৎসু ও যুক্তিঋদ্ধ, প্রাণময়তার প্রকাশ। ভোরের পাখি যেমন জাগে একাকী, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে, গান গায় মনের আনন্দে, সূর্য ওঠার পর সে মুখ লুকোয় রাঙা মেঘেদের ডানায়। ত্বকীও ছিল ঠিক তেমনি। তবে অন্যসব পাখিরা স্বার্থের নধর—দেহী জীবনে যখন বিলীন, কিশোর ত্বকী তখনও দেশপ্রেমের আগুনে খাক হওয়া ফিনিক্স পাখি। কারণ একজন মানুষ হিসেবে যা কিছু আমাদের সাথে সম্পৃক্ত তা ই তাঁকে ভাবিয়েছে গভীরভাবে। কোথাও সে স্বপ্ন দেখেছে গোটা মানবজাতিকে নিয়ে Let us walk together in peace. কোথাও বা লিখেছে, ‘মাটির সাথে বাস করা পিঁপড়ে হঠাৎ একদিন উঠে দাঁড়াল। ইচ্ছে তার মানুষ হবে।’ তরুণ প্রাণের দুর্দশায় তাঁর গভীর ও নিখাদ উদ্বেগ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, ন্যায়ের পক্ষে অকুতোভয় সাহস তাঁকে শব্দচিত্র দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তি জুগিয়েছে প্রবলভাবে। প্রথম আলোর ‘গোল্লাছুট’ পাতায় প্রায়ই ওর আঁকা। ছবি ছাপা হতো। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শিরোনামে একটা ছবিও এঁকেছিল ত্বকী। সবকিছু মিলিয়ে ত্বকী ছিল অলঙ্কার শোভিত ঘনঘটাময় মহাকাব্যের নৈর্ব্যক্তিক কবি। কিন্তু সে যে শেষ করে যেতে পারেনি তাঁর অমর মহাকাব্য। অবশ্য পারেনি বললে ভুল হবে। কারণ ‘একঝাঁক কুকুর’ এসে তাঁর কণ্ঠনালিকে চিরতরে ডুবিয়ে দিয়েছে— শীতলক্ষ্যার সেই নরম জলের শব্দে, সেই জল—ও তাকে চিনতো আলো বলে। প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ ড. মনিরুজ্জামানের ভাষায়: ‘হিটলারী ইহুদী নিধন বা আরও কোনও জঘন্যাধিক জঘন্য কায়দায় এক নির্দোষ দেবশিশুর প্রাণ সংহার। ত্বকীর শাহাদৎ অধর্মের হাতে নব্য এক এজিদী কারবালার হায় মাতমের আর এক তমোঘন ইতিহাস। এর কোন—ও বিনিয়োগ বা ফিরতি অবদান নেই, নেই অর্জন কোন—ও। আছে শুধু মর্শিয়া ক্রন্দন। আমরা এ অশ্রম্নকে বৃথা যেতে দেব না। শীতলক্ষ্যা চিরদিন গেয়ে যাবে তাঁর করুণ গাঁথার
মর্শিয়া।’

ত্বকী তুমি কি জানো গোল্লাছুট খেলার রাজা কিরণ আমাকে কি বলে? ও বলে, ও নাকি তোমার মতো মননশীল ও নির্ভীক হতে চায়। ওর হারিকেনের আলো কিংবা শাপলা ফুলের কণ্ঠমালা সবকিছুতেই নাকি লুকিয়ে আছো তুমি। ও নাকি আর
হারাতে দেবে না কোনো ত্বকীকে। আমি যখন তোমার কাছে লিখছিলাম, ও বলেছে, আমি যেন সে লেখায় ওর কথা বলি। ও বলে, ‘অন্তর হতে আহরি বচন, ত্বকী করে সবুজ বাংলায় বিচরণ।’ ছিল তোমার স্বল্পায়ু জীবন। এতটুকু জীবনেই প্রাণোচ্ছল ত্বকী মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছিল, বাবা মায়ের আনন্দের সঙ্গী ছিল সতত আর বাঙালির চিরন্তন পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনে তাঁর অনাবিল উচ্ছাস ছিল অফুরন্ত। কিশোর ছেলেটি যে প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার শিকার হয়েছিল, তা এখনো বিশ্ব মানবতাকে বিচলিত করে। ত্বকীর লাশ উদ্ধারের একদিন পরেই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে পালিত হয় নজিরবিহীন হরতাল। সেদিন অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল প্রাচ্যের ডান্ডির নির্ভীক জনতা।

অদ্ভূত অঁাধার আর—ও বেশি প্রকট হয়েছিল ২১ ফাল্গুন ১৪১৯ দুইবার। সেদিন বিকেলেও বই আনতে পাঠাগারে যাচ্ছিল ত্বকী। অতৃপ্ত পাঠাগারও অপেক্ষায় ছিল, কখন আসবে তার আলো। কিন্তু আলো যে আর আসেনি তার। ঐ দিনই চিরতরে নিভে গেলো তার দুর্লভ আলো। আচ্ছা লাইব্রেরির আটপৌরে বই কিংবা শীতলক্ষ্যার ঢেউখেলানো জল কি আজ—ও অপেক্ষায় আছে ওর? তাদের আলো কি ফিরবে আর?

মহাকবি মিল্টন বলে গেছেন: The childhood shows the man as the morning showas the day. আচ্ছা, ত্বকী যদি আজকে বেঁচে থাকত, তাহলে কত হতো ওর বয়স? হয়তো আটাশ। পুরোদস্তুর টগবগে তরুণ এক পুরুষের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হতো সে। আচ্ছা, দেখতে কেমন হতে ত্বকী? বিদ্রোহী — কন্ঠের রাশভারি চেহারা নাকি নিভৃত ভিন্ন কোন অবয়ব! তা যাই হোক, আদল দেখলে নিশ্চিত বোঝা যেত, এ আর কেউ নয়; তারুণ্যের পরিবর্তনের প্রোমিথিউস কিংবা দুর্নিবার
ইউলিসিস।

ত্বকীর স্মৃতিচারণে তাঁর মা লিখেছেন, ‘ত্বকী বেঁচে থাকতে একটা ছাড়া প্রায়ই শুনতে চাইত, মন্দরা ছিল, মন্দরা আছে, থাকড়েও চিরকাল। তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ কিন্তু আজকে কতটুকু অবসান ঘটেছে সেই মন্দের, ভালোদের জন্য কি শুভ হয়ে উঠেছে আগামীকাল! ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন। অথচ আজকে ত্বকী হত্যার দীর্ঘ এগারো বছরেও তদন্তকারীরা নিরব এবং আসামিরা রয়েছে সরব। কী দুর্ভাগ্য তাঁর। একটা অসুস্থ সমাজে জন্মেছিল ত্বকী, যে যুগে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছিল দেশ। কিশোর তারুণ্যের সিঁড়িতে পা রাখতে উন্মুখ ত্বকীকে হতে হলো নির্মম ও অপ্রত্যাশিত জিঘাংসার বলি। আচ্ছা শিশুহত্যা মহাপাপ, তাহলে ত্বকী হত্যা কি পাপ নয়? সকল হত্যার বিচার হলেও ত্বকী হত্যার বিচার কেনা হয় না? জায়গীরজোত থেকে ছেঁড়াদ্বীপের আমশুঁঠ ঘ্রাণমাখা ঘনজলে পিঙ্গল সবুজ পতাকাতোলা ডিঙি নৌকা কিংবা শীতলক্ষ্যার মাছরাঙা পাখি—ও লাল সবুজ দ্বৈত প্রচ্ছন্ন ডানার বাতাসে শব্দ করে বলে, ‘ত্বকী ফিরবি কবে তুই, তোকে ছাড়া নদীর জল কি করে ছুই?’ ত্বকী কি শুনতে পায় সে কথা? ছায়ানীড় শুভ্রদ্বীপ জড়ানো সমাপন বাগিচা থেকে আবার—ও ফিরবে কি ত্বকী? হ্যাঁ, আবারও ফিরবে ত্বকী, ফিরবে আরও শক্তিশালী হয়ে। কারণ— ত্বকী যে চির বিদ্রোহী বীর। মুছে যায় নি ত্বকীর আলো, মুছতে পারবেও না কেউ কোনোদিন।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের A man can be destroyed but not defeated উক্তিটি যেন ত্বকীরই প্রতিচ্ছবি। ত্বকী কোউকে আঘাত করেনি, কারও প্রতি অন্যায় করেনি। তারপরও তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বিচারের পাশাপাশি আর কোনো কিশোরকে যেন ত্বর্কীর মতো হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে না হয়, সেজন্য আমাদের আন্দোলন করতে হবে। তারুণ্যেম বাতিঘর ত্বকী আজেকে আমাদের প্রেরণা। তাঁর জীবন শৈল্পিক মননশীলতা ফিনিক্স পাখি হয়ে ডানা মেলে ধরে বাংলার আকাশে, তপসে মাছ হয়ে ঘাই মারে ডুবন্ত সভ্যতার নোনাজলে। এই ঘাই শুধু কি জল ঘোলাটে করবে নাকি বদলে দিবে জীবনের পরিধিকে, তার ভার সময়ের উপরেই রইল। সবশেষে বলতে চাই, ত্বকীর জ্ঞান, মনন ও জীবনাদর্শ আমাদের বহুমাত্রিক জীবনকে অগ্রসর করার পাথেয়। অন্ধকারকে হারিয়ে যে আলো ত্বকী জ্বালিয়েছিল তা বহমান থাকবে কাল থেকে কালান্তরে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও শিল্পের বিকাশে সময় আজও ত্বকীর মননশীলতা— কে অনুসন্ধান করে বেড়ায়। মুক্ত প্রোমিথিউস হয়ে অবিচারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মানুষের মাঝে আবার মুক্তির বার্তা নিয়ে আসবে ত্বকী কিংবা ইউলিসিসের মতো বলবে— Yes I said, yes I will, yes. পিটার প্যানের যেমন কখনোই বয়স বাড়ে না, ত্বকীর স্বপ্নেরও তেমন মৃত্যু হয় না।

ত্বকী লিখেছিল One is down, others are up। বর্তমান সময়ে ত্বকীনামার চর্চা আমাদের জন্য অতীব জরুরি। কারণ ত্বকী যে আমাদের দীপ্ত জয়োল্লাস অদম্য আত্মবিশ্বাস। ত্বকীনামার সংসর্গে নিপাত যাক নির্মমতা, ত্বকীদের হাত ধসে
দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে। আগামীর প্রজন্ম একদিন জানবে জিতেন্দ্রীয় এক প্রমিথিউস কিংবা দুর্নিবার একজন ইউলিসিস ছিল আমাদের।

(মো: ফাহাদ হোসেন ফাহিম ময়মনসিংহ’র বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। নবম জাতীয় ত্বকী রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় এ লেখাটি প্রথম হয়ে ত্বকী পদক পেয়েছে। আগামী ৮মার্চ ২০২৪ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।।)

RSS
Follow by Email