সুবিধাবঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে মুক্ততরীর ‘মুক্ত ইফতার’
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: মুক্ত খোলা ঈদগা, সারি সারি সাজানো খাবারের প্লেট। প্রটিতি প্লেটে আছে বেগুনী, আলুর চপ, পেয়াজু, মুড়ি, বুটসহ নানা আইটেম। সাথে থাকছে গ্লাস ভরা ঠান্ডা সরবত। বিগত ৪ বছর ধরে প্রতি রমজান মাসে অগনিত, সুবিধাবঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষদের ফ্রিতে ইফতারের ব্যবস্থা করে আসছে একটি সামাজিক সংগঠন। এই সংগঠনের আয়োজনে নগরীর জামতলা ঈদগাহ মাঠে প্রতিদিন ১০০ এর অধিক ইফতারের প্লেট অপেক্ষা করে রোজাদার ব্যাক্তিদের। ক্লান্তিভরা দিন শেষে মাগরিবের আজানের সময় হলেই দলে দলে এসে সাজানো প্লেটের পাশে বসে তারা। আজান দিলেই ইফতার শুরু করেন বড় ছোট নানান বয়সের মানুষ ।
শনিবার (১৫ মার্চ) নগরীর ঈদগা মাঠে মুক্ততরী নামক এ সংগঠনের এমনই ফ্রীতে ইফতারের আয়োজনের দেখা মেলে। ১৫জন ভলান্টিয়ার নিয়ে পুরো মাহে রমজান মাস ব্যাপি থাকে এমন ইফতারের ব্যবস্থা। প্রতিদিনের এ আয়োজেন খরচ হয় ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। মাস শেষে যে খরচের সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এ ছাড়াও ঈদের খুশিতে সুবিধাবঞ্চিতদের নতুন জামা দেওয়ার কর্মসূচি প্রায় প্রতিবছরই রাখে মুক্ততরী। তবে মুক্ততরীর আয়োজন শুধু এখানেই শেষ নয়। মুক্ত বিদ্যপীঠ, ২ টাকায় হাসি, প্রজেক্ট প্রত্যাশার আলো, লকডাউনে ত্রান সামগ্রী বিতরণ, বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া, অনলাইনে শিশু বিকাশে সহযোগিতা করা, বৃক্ষরোপণসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করে তারা।
এসময় ইফতার করতে আসা রিকশা চালক রাব্বি মিয়া বলেন, ‘সারা দিন রিকশা চালাইয়া যদি দোকান থেইকা ইফতার করতে যাই তাইলে ১০০ থেকে ১২০ টাকা খরচ পইরা যায়। এই টাকা আবার উঠাইতে গেলে আদা বেলা রিকশা চালান লাগবো। এখানে আমি গত ২ বছর ধইরা ইফতার করি। রিকশা চালাইয়া আইসা বসি, আমারে এখানের আপারা ভাইয়েরা খাবার দেয়। গতবছরও তাদের এক টাকায় ইফতারের ব্যবস্থা রাখছিলো। বাহিরে একটা বেগুনী ৫ টাকা আর এখানে পুরো ইফতারি করায় এক টাকা দিয়ে। আল্লাহ বলসে রোজাদারকে ইফতারি করালে সোয়াব হয়। আমি দোয়া করি আমগো মতন মানুষগো জন্য যেন এমন আয়োজন প্রতিবার করতে পারে সেই সামর্থ আল্লাহ মুক্ততরীরে দেক।’
১৩ বছরের পথশিশু সিয়াম বলে, ‘আমি রোজা রাখি না তাও আসি। আমার বুট মুড়ি মাখা খেতে অনেক ভালো লাগে। সারাদিন চাষাঢ়া থাকলেও বিকেল হলে ছোট ভাইকে নিয়ে এখানে এসে পড়ি। আমার ইফতার করতে ভালো লাগে।’
ইফতার করতে আসা আরেক নারী বলেন, ‘স্বামী দিনমজুরের কাজ করে আর আমিও বাড়ি বাড়ি কাজ করি। এক মেয়েকে নিয়ে সংসার অনেক কষ্টে চলে। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। সামান্য দুই মা-মেয়ে ৫০ টাকার নিচে ইফতার করা যায় না। কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। মুক্ততরীর এই ইফতার আয়োজন শুরু হলেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এখানেই ইফতার করি। গরীব মানুষগো জন্য এ আয়োজনে কোনো কমতি নেই। সারা দিন রোজা রেখে এখানে তৃপ্তি নিয়ে পেটপুরে খেতে পারি।’
এ বিষয়ে মুক্ততরীর প্রতিষ্ঠাতা জয় দত্ত বলেন, আমাদের মুক্ততরীর যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সাল থেকে। একটা শিশু স্কুলের মাধ্যমে যার নাম ছিল মুক্ত বিদ্যাপীঠ। সেখানে আমরা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদানের ব্যবস্থা করতাম এবং সেটা ছিল নবীগঞ্জ ঘাটে। কিন্তু করোনার সময় ও এর পরবর্তী সময়ে আমরা সেই স্কুল টা আর কন্টিনিউ করতে পারি নি। আমাদের আর্থিক কিছু সমস্যা বা সার্বিক সমস্যা থাকায় আমরা আর কন্টিনিউ করতে পারি নি। এর পাশাপাশি ২ টাকায় হাসি, প্রজেক্ট প্রত্যাশার আলো, লকডাউনে ত্রান সামগ্রী বিতরণ, বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া, অনলাইনে শিশু বিকাশে সহযোগিতা করা, বৃক্ষরোপণসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। আমরা লক্ষ করি যে নারায়ণগঞ্জ অনেক কর্মব্যস্ত একটা শহর। এখানে মানুষ রমজান মাসে সঠিক সময়ে বাসায় যেতে পারে না। বাহিরে ইফতার করতে হয়ে কিন্তু মাঝে মাঝে বাহিরেও ইফতার পায় না।সেই থেকেই আমার ইচ্ছা ছিলো যারা বাসায় পৌছাতে পারছে না তারা যেন একসাথে বসে ইফতারটা করতে পারে। তাই ২০২২ থেকেই আমাদের এই মুক্ত ইফতার শুরু করি। তবে শুধু যে রোজাদাররা খেতে পারবে এমন না, যারা খুদার্থ তারাও এসে এখানে খাওয়া দাওয়া করতে পারবে। সবার জন্য এই আযোজন করে থাকি। রমজান মাসে আমাদের এই কার্যক্রম চালাতে প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকা খরচ পড়ে যায়। কারণ মাঝে মাঝে ডিম খিচুরি বা বিরিয়ানীর ব্যবস্থা ও থাকে। শুরুতে প্রথম কয়েক রোজায় আমরা যারা শিক্ষার্থী আছি তারাই নিজেস্ব অর্থায়নে এই আয়োজন করি। তারপর দেখা যায় যারা আমাদের শুভাকাঙ্খি আছে তারাও আমাদের সহযোগীতা করে। মুক্ততরীর লক্ষ হচ্ছে আজকের সুবিধা বঞ্চিতশিশু আগামী দিনে সুবিধা প্রদানকারী হবে। এছাড়াও বর্তমানে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে আমরা কাজ করছি।