না.গঞ্জে কমরেড রতন ‘সরকার যায়-আসে কিন্তু ন্যায্য মজুরির লড়াই চলতেই থাকে’
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদন, উন্নয়ন আর অগ্রগতির পিছনে আছে ৭ কোটি ৩৭ লাখ শ্রমিকের শ্রম। শিল্প—কৃষি এবং সেবামূলক খাতে যা কিছু উৎপাদন হয় তার সাথে যুক্ত আছে শ্রমজীবী মানুষ। শুধু দেশে নয় প্রবাসেও প্রতিদিন পরিশ্রম করছে তারা দেশের জন্য। তা সত্ত্বেও এক বৈষম্যের জালে আটকে আছে দেশের শ্রমজীবী মানুষ। তারা উৎপাদন বাড়ায়, রপ্তানি বাড়ায়, রেমিটেন্স বাড়ায় কিন্তু নিজেদের আয় বাড়ে না, অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না। সরকার যায় সরকার আসে ন্যায্য মজুরি আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের লড়াই চলতেই থাকে। দেশের জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার যা টাকার অঙ্কে ৫৪ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু শ্রমজীবীদের জীবনে এই জিডিপি বৃদ্ধির কোন সুফল কি আছে? প্রতিবছর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব দেয়া হয়, রপ্তানি আয় বৃদ্ধির গর্ব করা হয়। এর সাথে তাল মিলিয়ে কৃষক—শ্রমিকের আয় বাড়ে না। মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার ধরে ৪ সদস্যের একটি পরিবারে মাসিক আয় হওয়ার কথা ১ লাখ ১২ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু শ্রমিকের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি করলে উত্তেজিত হয়ে উঠে মালিক শ্রেণি এবং সরকার। তারা ভাবতে চায় না কীভাবে শ্রমিকের সংসার চলে, কী খায়, তাদের সন্তানের লেখাপড়া হবে কীভাবে আর শ্রমিক বৃদ্ধ বয়সের জন্য কিছু সঞ্চয় করবে কীভাবে? দেশের উন্নতির জন্য শ্রম দিয়ে বঞ্চনা আর প্রতারণাই যেন শ্রমিকদের পাওনা।
শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রমিক সমাবেশ ও শহরে লাল পতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের আয়োজিত এ সমাবেশে উপস্থিত থেকে এ কথা বলেন কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন।
রাজেকুজ্জামান রতন আরও বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ছাড়া শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া কঠিন। শ্রমিকদেরকে অসংগঠিত রাখতে ২০০৬ সালে প্রবর্তিত এবং ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সংশোধিত শ্রম আইনের ১৭৯ ও ১৮০ ধারার মাধ্যমে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। শ্রম আইনের ২৩ ধারা ব্যবহার করে হয়রানি ও ২৬ ধারার বলে মালিকের হাতে শ্রমিক ছাঁটাই করার অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মুত্যু হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা । অন্যদিকে যারা অসংগঠিত খাতে কাজ করে যেমন— হালকা যানবাহন, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, পরিবহন, মোটর মেকানিক, তাঁত, নির্মাণ, পাদুকা, হকার, দিনমজুর তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাদের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা বলতে কিছু নেই। আউট সোর্সিং ও ঠিকাদারি প্রথা চালু করে শ্রমিকদের স্থায়ী চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হাজারো শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছিলেন, শত শত শ্রমিক জীবন দিয়েছিলেন তাদের আশা ছিল যে, তারা ন্যায্য মজুরি পাবেন, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাবেন। অভ্যুত্থানের আগে শ্রমিক রক্ত দিয়েছে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আর এখনও জীবন দিচ্ছে বকেয়া মজুরি আদায়ের জন্য। দ্রব্যমূল্য বাড়ে প্রতিবছর কিন্তু শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করা হয় পাঁচ বছর পর, মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ১২ শতাংশ কিন্তু ইংক্রিমেন্ট ঠিক করা হয়েছে ৯ শতাংশ ফলে শ্রমিক মজুরি হারাবে প্রতিবছর। কর্মক্ষেত্রে প্রাণ হারানো শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা। শ্রমিকের পেনশন নেই, অবসর নিলে বা দুর্ঘটনার ফলে সে অসহায় হয়ে পড়ে। কম মজুরি, ক্ষতিপূরণ কম, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নেই, এই সব বঞ্চনার জীবন শ্রমিকের। শ্রমিকের জীবন যেন বৈষম্যের দেয়াল ঘেরা। আইনে বৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য, নারী—পুরুষের মজুরি বৈষম্য, অধিকারে বৈষম্য সবই যেন শ্রমিকের জন্য। ফলে তাঁরা খাদ্য—পুষ্টি, শিক্ষা—চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু শ্রমিক নয় এর প্রভাব পড়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপরেও। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপি বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, রেমিটেন্স বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকের জীবনমান কেন বাড়বে না সেই দাবি আজ সবক্ষেত্রেই। একটা কথা মনে রাখতে হবে শ্রমিকের দুঃখ দুর্দশা কোন কপালের লিখন নয়, এর একটা নিয়ম আছে। শোষণের কারণে শ্রমিকের বাড়ে দুঃখ আর মালিকের বাড়ে মুনাফা। পুঁজিবাদী সমাজের এই নিয়ম যতদিন বহাল থাকবে ততদিন শ্রমিক পাবে না তার ন্যায্য মজুরি।
রতন বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা, ’৯০ এর অভ্যুত্থানের পর ধনী ও মালিকরা ক্ষমতায় থাকায় যেমন শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, ’২৪ এর গণ অভ্যুত্থানের পরও তেমনি শ্রমিকের শোষণ বন্ধ হবে না। ইতিহাসের এই শিক্ষাকে ধারণ করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে সমাজবদলের লড়াইয়ে পরিণত করতে হবে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট শ্রেণি সচেতন ও সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আন্দোলনের চাপে কখনো মজুরি বাড়ালেও জিনিসপত্রের দাম, বাসাভাড়া, চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে তা আবার শ্রমিকদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়। ফলে শুধু মজুরি বৃদ্ধি নয় এর সাথে আবাসন, রেশন, চিকিৎসা, শিক্ষার অধিকারের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনে বিজয়ী হতে হলে দমন পীড়ন মোকাবিলা করে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আদর্শভিত্তিক সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে হবে।
সমাবেশে দলের জেলা সভাপতি আবু নাঈম খান বিপ্লবের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি সেলিম মাহমুদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সহসভাপতি এম এ মিল্টন, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শরীফ, রি—রোলিং স্টিল মিলস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি জামাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির। সমাবেশে গণসংগীত পরিবেশন করে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলা।