বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫
Led01Led05অর্থনীতি

উৎকণ্ঠায় ব্যবসায়ীরা, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে থমকে যাবে শিল্পায়ন

# ৩০টাকাই যদি অস্বাভাবিক মূল্য হয়, তাহলে ৭৫ টাকায় কোন শব্দ খুজেঁ পাচ্ছি না: হাতেম
# গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলো বাস্তবতা বহির্ভূত সিদ্ধান্ত: চেম্বার সভাপতি মাসুদুজ্জামান
# দেশের এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা উচিৎ না: সেলিম সারোয়ার

লাইভ নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের শনির দশা কাটছে না; বরং আরও কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ডলার সংকট, আমদানি কড়াকড়ি, সুদের উচ্চহার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হামলা-মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই শিল্পে গ্যাসের দাম নতুন করে ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত বা আড়াই গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমনিতেই আগে থেকে বাড়তি দর দিয়েও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না শিল্প। এখন আবার নতুন করে ব্যাপক হারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে রীতিমতো স্তম্ভিত ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ী বলছেন, এটি বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশে আর কোনো শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে না। গ্যাসের আড়াই গুণ মূল্যবৃদ্ধি হলে টিকবে না শিল্প খাত। এর মাধ্যমে শিল্পের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থান হবে না।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিরুৎসাহী হবেন। বড় ধরনের প্রভাব পড়বে রপ্তানিশিল্পে। এতে শিল্পের প্রসারের স্থলে বরং শিল্প সংকুচিত হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় বিপুলসংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। এমতাবস্থায় গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব শিল্প খাতকে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, গ্যাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারী শিল্প। আর এসব শিল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ থাকে। শিল্পটির ক্ষতি হলে, ঋণখেলাপি হওয়ার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। অনেকে চাকরি হারাবেন। এরই মধ্যে বহু শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। নতুন করে শিল্পের ওপর চাপ এলে, দেশের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশে ভুল বার্তা যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অন্য গন্তব্যে চলে যাবেন। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এসব কর্মকাণ্ড রীতিমতো শিল্প ধ্বংসের লক্ষণ। এর পেছনে কোনো চক্রের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। এ ধরনের কোনো অপচেষ্টা থাকলে সরকারে উচিত যেকোনো মূল্যে তা থামানো।

এরই মধ্যে গ্যাসের নতুন দরের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। প্রস্তাবটি এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) রয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে নতুন কারখানার জন্য গ্যাসের দাম হবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি ব্যয়ের সমান। ফলে নতুন কারখানাগুলোকে বর্তমান দরের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হবে। পুরনো শিল্পকারখানায় লোড বাড়াতে চাইলেও গুনতে হবে আড়াই গুণ মূল্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বর্তমানে শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। গত সোমবার বিইআরসিতে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকছে প্রস্তাবে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে দুই বছর আগে শিল্পের গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি; বরং গ্যাস সংকটে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকটের মধ্যে গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়ানো হলে শিল্পে বিনিয়োগ পুরো বন্ধ হয়ে যাবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রনালয়ের সিপিজিসিবিএল’র ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর (স্বতন্ত্র পরিচালক) ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিগত সরকার ১২ টাকার গ্যাস যখন ৩০ টাকা করলো, তখনই আমরা বলেছিলাম যে, আমাদের সাথে রীতিমতো প্রতারণা করা হয়েছিলো। আমাদের বলা হয়েছিলো আমাদের কন্টিনিউয়াস গ্যাস দিবে। কিন্তু অস্বাভাবিক একটা মূল্য বৃদ্ধির পরও আমরা ঠিক মতো গ্যাস পাইনি। এখন কথা হলো ৩০টাকাই যদি অস্বাভাবিক মূল্য হয়, তাহলে ৭৫ টাকা আমরা কোন হিসেবে ধরবো? আমি কোন শব্দ খুজেঁ পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, ৭৫টাকা যে মূল্যের যে প্রস্তাব দিয়েছে, এতে আসলে কোন শিল্পায়ন হবে না। নতুন করে কেউ গ্যাস কানেকশন নিবে না। গ্যাস নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান করার চিন্তা আর কেউ করবে না। বিগত সময় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) একটা গণশুনানি করতেন, লোক দেখানো গণশুনানি। আমরা আশাকরি এই সরকারের আমলে লোক দেখানো গণশুনানি হবে না। প্রকৃত গণশুনানি করে প্রকৃতভাবে যেটা মূল্য হওয়া উচিৎ, সেটা নির্ধারণ করবে সরকার আর এটাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে। পাশাপাশি সরকারকে বলবো তারা যাতে আমদানির দিকে নির্ভর না বাড়িয়ে, দেশীয় গ্যাস আহরণের জন্য সচেষ্ট হয়। তাহলে ৭৫ টাকা দিয়ে এই এলএনজি কিনে সরবরাহ করতে হবে না। আর তিতাসের সিস্টেম লসের নামে যে চুরি, এই চুরিটা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে মূল্য বৃদ্ধি করা লাগবে না।

নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও মডেল গ্রুপের এমডি মাসুদুজ্জামান বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলো বাস্তবতা বহির্ভূত সিদ্ধান্ত আমার কাছে মনে হয়। যারা এই প্রস্তাব করছে, কার সাথে আলোচনা করে করছে, কি বুঝে করছে, আদো আলোচনায় কোন ব্যবসায়ী ছিলো কিনা জানিনা। বিকেএমইএ-বিজেএমইএ, ফেডারেশন অথবা সাধারণ ব্যবসায়ীর সাথে আলোচনা করে করছে কিনা আমার তা মনে হয় না। এটা একটা অবাস্তব চিন্তা ধারা মনে হয়েছে। ব্যবসায়ীরা শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা, এক কথায় ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হওয়ার উপক্রম এটা। এমন চিন্তা কিভাবে করে বুঝিনা, এটা এমন হতে পারে যে আলোচনার জন্য প্রস্তাবটা রাখা। এই আলোচনার জন্য এই প্রস্তাব কিভাবে রাখে।

তিনি আরও বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো ব্যবসায়ী মহলে একটা বিরুপ প্রভাব পড়বে। ৫ আগস্টের পরে অনেক ব্যবসা আরেক দেশে চলে গেছে। আমরা যখন কস্ট মিনিমাইজ করতে পারবো না। তখন স্বাভাবিকভাবে বায়াররা কি করবে। তারা তো পার্শ্ববর্তী কোন না কোন জায়গায় চলেই যাবে। এই মুহুর্তে আমরা ভীত, প্রচন্ড ভয়ের মধ্যে আছি। ইতোমধ্যে ৫ থেকে ৯ পার্সেন্ট শ্রমিকের ভাতা বাড়ায় দিলো, আমরা এটার বিরোধীতা করি না। কিন্তু আমাদের সাথে সরকার আলোচনা করে নাই যে, আমরা এই বর্ধিত পয়সা কিভাবে দিবো। আমরা এই সিদ্ধানের বিরুদ্ধে না, কিন্তু সরকার তো আমাদের একটা গাইড লাইন তো দিবে। আমি কিভাবে সার্ভাইব করবো কোথা থেকে টাকা টা এনে দিবো।

বাংলাদেশ নিটিং ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম সারোয়ার বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লে নারায়ণগঞ্জ না শুধু সারা দেশের ব্যবসায় পরিস্থিতি শোচনীয় পরিস্থিতিতে চলে যাবে। এমনিও আমরা গ্যাস পাইনা। এর আগেও কয়েকবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাইছে, আমরা ঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারি নাই। এটা যদি আবার বাড়ে, যেখানে আমরা গ্যাসই পাচ্ছি না। সেখানে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন রাস্তা থাকবে না। বিগত সরকার বলেছে গ্যাসের দাম বাড়ালেও পর্যাপ্ত গ্যাস দিবে, কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। এমনিতেই আমরা সমস্যার মধ্যে আছি তার উপর যদি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। তাহলে অচিরেই অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। আমি মনে করি দেশের এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা উচিৎ না। আমরা এটা মনে করি।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি জারি করা নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিন গুণ করা হয়। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে মঙ্গলবার পেট্রোবাংলা সরবরাহ করে দুই হাজার ৭০৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে দেশীয় কূপ থেকে পাওয়া আছে এক হাজার ৯২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং বাকি ৭৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হয়। চাহিদা ও সরবরাহে দৈনিক ঘাটতি থাকছে প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

RSS
Follow by Email