৩৯ বছরে প্রথম না.গঞ্জে প্রকাশ্যে জামায়াতে জনসভা, নেতাকর্মীদের ঢল
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: ঢাকা জেলা থেকে আলাদা হওয়ার ৩৯ বছর পর নারায়ণগঞ্জে প্রথম বারের মতো প্রকাশ্যে সফল জনসভা করলো, বাংলাদেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর আগে জামায়াতের প্রয়াত আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের নারায়ণগঞ্জ আসার কথা থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তবে এবারের জনসভাকে কেন্দ্র করে কঠোর অবস্থানে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ সদস্যদের। হাজার হাজার নেতাকর্মীর সমাগমে নারায়ণগঞ্জের মানুষদের অস্তিতের জানান দিয়েছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল।
সরেজমিন, পূর্ব ঘোষিত সময়ের আগেই ভোর থেকে ফতুল্লার ইসদাইর এলাকায় ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে লোকজন আসতে শুরু করে। নগরজুরে বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে স্বেচ্ছাসেবীদের উপস্থিতির মাধ্যমে নগরীর শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়েছে। সমাবেশ স্থল থেকে শুরু করে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলোতে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি ছিলো বলে জানায় পুলিশ। ভোরের আভাস শেষ হতেই স্টেডিয়ামের মাঠে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে। স্টেডিয়ামের বাহিরে বড় পর্দায় জনসভা দেখার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে ছিলো। তবে সেখানেও মানুষের জায়গা দেয়া সম্ভব হয়নি, এতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। জনসভার শুরুতেই বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য পেশ করেন।
শুক্রবার নারায়ণনগঞ্জ জেলা ও মহানগর জামায়াতের নেতাকর্মীদের আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এছাড়া জনসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর সাবেক আমির মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমদ, জেলা আমির মমিনুল হক সরকার ও মহানগরী আমির মুহাম্মদ আবদুল জব্বার, নারায়ণগণ্য জেলা শিবিরের সভাপতি আবু সুফিয়ানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
জামায়াতে ইসলামীর এই জনসভায় শুধু মুসলমান নয় সনাতন ধর্মের নেতৃবৃন্দ উপস্থিতও লক্ষ্য করা গেছে। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যান ট্রাস্টের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি জয় কে রয় চৌধুরী বাপ্পী, নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন, মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বিষ্ণুপদ সাহা, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সুশীল দা প্রমূখ।
জনসভায় প্রধান অতিথি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে কে কোন ধর্মের এই প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। ১৮ কোটি মানুষের দেশ একটা সাজানো ফুলের বাগান। আল্লাহ যাদেরকে এই বাগানে পয়দা করেছেন মিলেমিশে সবাই হবে এর অধিবাসী। বাংলাদেশের সংবিধান সবাইকে সাংবিধানিক অধিকার দিয়েছে। বিগত ৫৪ বছর এ জাতিকে ভাগ করে রাখা হয়েছে। এই কাজটি সুকৌশলে আওয়ামী লীগ করেছে। বিভক্ত জাতি কখনো বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। সংবিধান যত অধিকার দিয়েছে সব এদেশে নিশ্চিত হবে। শাসন ক্ষমতায় যারা যাবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব এটা কোনো দয়ার দান নয়। বাঁচার অধিকার, সম্মান পাওয়ার অধিকার, বিচার পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার, সন্তানের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার, কাজের অধিকারসহ সবকিছু তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। এটাই স্বাধীনতার মূল চেতনা। এই সমাজ হবে বৈষম্যহীন, মানবিক।
তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে কষ্টে আছেন নারায়ণগঞ্জবাসী, নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাসের রাজধানী বানিয়ে রাখা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জেও যদি চাঁদাবাজি দখলদারি হয়, অফিস আদালতে ঘুষ চলে, তাহলে কেন এতগুলো মানুষের জীবন গেল, কেন এত মানুষ পঙ্গু হলো, কেন এতগুলো রক্তের ফোটা ভাসল? আমি বিনয়ের সাথে দল মত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে অনুরোধ করব, এই অপকর্মের সাথে যারাই জড়িত আছেন মেহেরবানি করে এই অপকর্মগুলো ছেড়ে দেন। এই অপকর্ম করলে এই শহীদদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। তাদের রক্তের সাথে অপমান করা হবে। ১৮ কোটি মানুষকে অপমান করা হবে। মানুষকে স্বস্তিতে বাঁচতে দেন।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ পরিষদ কল্যান ট্রাস্টের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি জয় কে রয় চৌধুরী বাপ্পী বলেন, একটি বিশাল জনসভা যেখানে বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র গঠনের স্লোগান দেয়া হয়েছে এর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান রইলো। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা গত ১৫ বছর একসাথে চা খেতে পারিনি। কেন তা আমাদের অজানা নয়। এই সম্প্রীতির শহর নারায়ণগঞ্জে কি আমরা এই ধরনের বৈষম্য দেখতে চেয়েছি? চাইনি কারণ আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি। একই সাথে পাশাপাশি শ্মশান, গোরস্থান। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্ট্রান ও সর্বপরি মুসলিম সম্প্রদায়ের মাটি। এই সম্প্রীতি আমরা বজায় রাখবো। এখানে আমরা সবার আগে মানুষ। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মকে সম্মান জানাতে হবে।
নারায়ণগণ্য জেলা শিবিরের সভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা জানি বিগত শেখ হাসিনা সরকার আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাসগুলো আমাদের প্রাণের ঠিকানায় প্রবেশ করতে দেয় নাই। ছাত্র সমাজের হাতে মাদক অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। এগুলো করে তারা তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিল। এই সমাবেশ থেকে আজ আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চাই, নারায়ণগঞ্জে এমন কোন প্রতিষ্ঠান থাকবেনা যেখানে ইসলামী ছাত্র শিবির থাকবেনা। এখন কোন ছাত্র থাকবেনা যাদের হাতে বই কলম থাকবেনা।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতে ইসলামীর সমাজকল্যান বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ইলিয়াস মোল্লা বলেন, আমরা দেখেছি এই নারায়ণগঞ্জে গোলাম আজমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আর আমাদের নেতাদের নারায়ণগঞ্জবাসী এখানে নিয়ে এসেছে। যারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল আজ তারা কোথায়? আজ নারায়ণগঞ্জবাসী আমাদের গ্রহণ করেছে। আগামী দিনে যেন আমরা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারি সেজন্য আমাদের জন্য দোয়া করবেন পাশে থাকবেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রশিবিরের সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি হাফেজ ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য শুনি। যখন আমরা বিভিন্ন স্থানে পরিচয় দেই আমরা নারায়ণগঞ্জে ইসলামী ছাত্রশিবির নিয়ে কাজ করি তখন তাদের একটা কথা থাকে। সেটা হলো, নারায়ণগঞ্জ মানে গডফাদার, নারায়ণগঞ্জ মানে সন্ত্রাস। এটা আমাদের লজ্জিত করে। আমরা আর লজ্জা পেতে চাইনা। আমাদের নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার হোক আমরা চাইনা। রাজনৈতিক দলগুলোকে আহবান করবো ছাত্রদেরকে আর আপনারা এসব কাজে ব্যবহার করবেন না। নারায়ণগঞ্জে ভালো কোন প্রতিষ্ঠান নেই, ভালো কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই, মেডিকেল কলেজ নেই। আমরা এই সমাবেশ থেকে দাবি করবো অতি শিগ্রই যেন নারায়ণগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মাওলানা মাইনুদ্দিন আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে একটি সন্ত্রাসী পরিবার, কিছু সন্ত্রাসী লোক, শামীম ওসমানসহ বাংলাদেশের স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনাসহ শামীম ওসমান পালিয়ে যাবার পরেও তাদের কিছু দোসর এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আমরা বুঝতে পারিনি, এখনো তারা কিভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে। কারা তাদেরকে বাংলাদেশে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে? তারা যত বাংলাদেশে থাকবে তত বাংলাদেশে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবেই। যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখী করার জন্য সরকারের কাছে আহবান জানাচ্ছি। এত বছর যারা সরকার পরিচালনা করেছে তারা উন্নয়নের নামে সারা বছর শুধু লুটপাট চুরি ডাকাতি করেছে। দেশের সকল টাকা পয়সা লুটপাট করে চুরি ডাকাতি করে বিদেশে পাচার করে দিয়ে তারা এখন বিদেশে গিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছে। আর বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জে উন্নয়নের নামে লুটপাট ছাড়া কিছুই করেনি।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর জামায়াত ইসলামের আমির আব্দুল জব্বার বলেন, জালাই আগস্টের হত্যায় পরে কাউকে গ্রেপ্তার করতে দেখি নাই। সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানেকে গ্রেপ্তার করতে দেখিনি। আমাদের দাবি নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, ত্বকী হত্যার বিচার করতে হবে। শামীম ওসমান ক্ষমতার জন্য ফতুল্লাবাসীকে সিটি কর্পোরেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।