সোনারগাঁয়ে পরটা থাপড়িয়ে চলে যাদের সংসার !
# রাজা-বাদশার আমলের থাপড়ানো রুটি
# ১দিনে বিক্রি হয় প্রায় ৫-৭শ’ কেজির আটার রুটি
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: রুটি বা পরোটা, সাথে ভাজি কিংবা মিস্টি দিন রাত যে কোন সময়ের দারুন নাস্তা। আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির খুব পরিচিত একটি খাবার। মুখরোচক এ খাবার স্থান-কাল বিশেষে ভিন্নতা যেমন রয়েছে স্বাদে, তেমনী রয়েছে নামেও। প্লেন পরোটা, প্যাচ পরোটা, শাহি পরোটারসহ বহু নামে প্রচলিত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁয়ে ‘থাপড়ানো পরোটা’র নাম জানেন না অনেকেই।
গ্রামবাংলার হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এমন একটি ছবি কল্পনায় নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা কাইকারটেক হাট। প্রায় ২০০ বছর ধরে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করা হাটটিকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জ ও তার আশপাশের জেলার ব্যবসায়ীদের মিলনমেলা তৈরি হচ্ছে যুগের পর যুগ। প্রতি রবিবারের হাটের এই হাটের যাত্র শুরু করে বড় আকারের থাপড়ানো রুটি খাওয়ার মাধ্যমে। বিভিন্ন জেলা উপজেলারর লোকজন হাটের যাত্রা শুরু করে এই রুটি খাওয়ার মাধ্যমে। কেউ রুটির দোকানে বসে রুটি খান, আবার কেউ পরিবারের জন্য কিনেও নিয়ে যান। ৬-৭জন রুটির দোকানীরাই কাইকারটেক হাটের পুরোনো এই থাপড়ানো রুটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তবে কালের বিবর্তনে দোকানের সংখ্যা কমলেও থাপড়ানো রুটি চাহিদা আর সুনাম একটুও কমেনি। বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই রুটির ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন তারা, তবে সামনে কারা থাকবে এ নিয়ে আছে সংশয়।
ব্রক্ষপুত্র নদের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে গড়ে উঠেছে কাইকারটেকের হাট। বাংলাদেশের সব হাট একটি প্রথাগত সময় মেনে চলে। তারই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহে প্রতি রবিবার হাটটি সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সড়ক ও নদীপথ ধরে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে হাজির হন কাইকারটেক হাটে। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদীর ব্যবসায়ীরাও ছুটে আসেন এই হাটে। শুধু সকালের নয়, কেউ কেউ দুপুরের খাবারও সারেন হাটের এই ঐতিহ্যবাহী ‘থাপড়ানো রুটি’ দিয়ে।
নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে থাপড়ানো রুটি বিক্রি করে আগের মতো লাভ না হলেও বাপ-দাদার শত বছরের ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন কাইকারটেকের হাটের এসব দোকান মালিক। হাটের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই থাপড়ানো রুটি তৈরির বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। রুটি তৈরির কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন আর দোকানের কর্মচারীরা ক্রেতাদের চাহিদামতো রুটি দিচ্ছেন। কেউ দোকানে বসেই রুটি-মিষ্টি খাচ্ছেন আবার কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য কেজি দরে রুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সাপ্তাহিক এই হাটের দিনে থাপড়ানো রুটির চাহিদা বেশি থাকে। এদিন প্রতিটি দোকান মালিক ৫০ থেকে ৭০ কেজি আটার থাপড়ানো রুটি বিক্রি করে থাকেন। প্রতিটি রুটি ২০টাকা করে বিক্রি হয়। অন্যদিকে কোন কোন ক্রেতাদের অভিযোগ, এই হাটে দোকানিরা কাস্টমারের সাথে দুর্ব্যবহার করে। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই অন্য কাস্টমার বসাতে উঠিয়ে দেয়া হয় আগেভাগেই।
রুটি খেতে আসা ক্রেতারা জানায়, প্রতি রবিবার এখানে আসি। এই হাটে খাবার অনেক উন্নত মানের। এই হাটে পরটার নাম থাবড়ানো রুটি। রুটির মান ভালো এবং অনেক বড় সাইজের রুটি। দুইটা রটি একজনের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। এই হাটের রুটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। সপ্তাহে একবার এসে নিয়ে যাই। আমি ১০পিস রুটি নিতে এসেছি। খাবার খুব ভালো এবং সুস্বাধু। বৃষ্টির মধ্যেও ঢাকা থেকে এসেছি এই হাটে। খাবারের মান নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নাই, তবে দাম নিয়ে আমার বেশ অভিযোগ আছে। দেশীয় খাবার গুলো ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে।বাজার মনিটরিং যারা করে তাদের ব্যাপারটা দেখা উচিৎ। নয়তো নিন্ম আয়ের মানুষ কিনতে পারবে না। এখানে খেতে আসলে কিছু কিছু দোকানদার অর্ধেক খাবার শেষ না হতেই বলে উঠে পরেন, এটা কেমন ব্যবহার। এতে মানহানির পর্যায়ে চলে যায়।
রুটি কারিগর ও ব্যবসায়ীরা জানায়, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে থাকড়ানো পরটা থেকে আসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পরটার সাথে ডাল-ভাজি, দই মিষ্টি খায় মানুষ। ফজরের পর এসে অবশর পাইনা। প্রতিটা দোকানে প্রায় ৫০ কেজি করে রুটি বিক্রি করে। থাবড়ানো পরটা খেতে খুব স্বাধ আছে। ২৬ বছর ধরে এই লাইনে আছি। বৃষ্টিতে বেচাঁকেনা কম নয়তো এতোক্ষণে সব বেচা হয়ে যেতো। আমার আগে আবার ভাই করছে, তার আগে বাবা করছে, দাদা করছে। চারদিকে হাটবাজার বেশী হওয়ায় হাটবাজার একটু বেশী। সকাল ৬টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিক্রি করি পরটা। কেউ বসে খায় আবার কেউ পার্সেল করে বাড়ি নিয়ে যায় কেজি দরে। এটার সাথে ডাল-ভাজি, দই, মিষ্টি খাওয়া যায়। আগের থেকে মোটামুটি ভালো আছে চাহিদা। বসে খাওয়ার চাইতে পার্সেলর সংখ্যাই বেশী। পিস বিক্রি করি ২০ টাকা কিন্তু কেজি ১৮০ টাকা করে।
এদিকে, কাইকারটেক হাটে যেতে হলে রাজধানীর গুলিস্তান থেকে বাসে সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামলে হাটে যাওয়ার সিএনজি পাবেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাড়া থেকে নবীগঞ্জ ঘাট পার হয়েও কাইকারটেক হাট যাওয়া যায়। আর মুন্সিগঞ্জ থেকে নৌরুটে ট্রলার বা বোট ভাড়া করে সরাসরি পৌঁছাতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী এ হাটে।