শ্রদ্ধা-অদম্য সাহসের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে না.গঞ্জে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে’র উদ্বোধন
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: আজকের এই দিনটি কেবল একটি ক্যালেন্ডার তারিখ নয়, এটি একটি অশ্রুসিক্ত মুহূর্ত, এক নীরব আত্মত্যাগের মহাকাব্য। যে অগণিত প্রাণ জুলাই মাসের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁদের অমর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে সোমবার নারায়ণগঞ্জে উন্মোচিত হলো ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্মিত এই স্থাপনা শুধু একখণ্ড পাথর নয়, এটি বাঙালির অবিচল সংকল্প আর সম্মিলিত চেতনার মূর্ত প্রতীক। প্রতিটি ইট, বালু ও সিমেন্টের কণা যেন ধারণ করে আছে সেই সব বীর শহীদের রক্ত, ঘাম আর অদম্য সংগ্রামের গল্প, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহস যোগাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে উপদেষ্টারা নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেই প্রথম কাজ ছিল শহীদ পরিবারদের সান্নিধ্যে যাওয়া। তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা জানান, তাঁদের পাশে চিরকাল থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। শহীদ পরিবারদের হাতে শ্রদ্ধার ফুল তুলে দেওয়ার সময় উপদেষ্টাদের চোখে ছিল শোকের গভীর ছাপ, কিন্তু কণ্ঠে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অদম্য প্রত্যয়। এরপর উপদেষ্টামণ্ডলী ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে’ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জুলাইয়ের সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই নিস্তব্ধ মুহূর্তে যেন পুরো প্রাঙ্গণজুড়ে এক নীরবতা নেমে আসে।

স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধনের পর এক অস্থায়ী মঞ্চে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন করা হয়। উপদেষ্টাদের জন্য সাজানো হয়েছিল সুউচ্চ আসন, কিন্তু তাঁরা সেখানে বসেননি। বরং এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে তাঁরা নিজেদের আসন ছেড়ে দেন শহীদ পরিবারদের জন্য। তাঁদের পাশে বসে, মঞ্চের পদদেশে বিনম্র ভঙ্গিতে অবস্থান গ্রহণ করেন উপদেষ্টারা। এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য উপস্থিত সকলের হৃদয়ে এক গভীর রেখা এঁকে দেয়, যা শহীদ পরিবারদের প্রতি তাঁদের অগাধ সম্মান আর একাত্মতার পরিচায়ক। অনুষ্ঠান শেষে উপদেষ্টামণ্ডলী শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বৃক্ষরোপণ করেন এবং এই ভূমি থেকে বিদায় নেন।
অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তাঁর আবেগঘন বক্তব্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, “আমাদের লোকদের এমনভাবে হত্যা করা হলো, অঙ্গহানি করা হলো, এর বিচার কোথায়? আমি দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই বিচার এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শাসনামলেই এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে।”

গত পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে জনগণের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, “আপনাদের যে আত্মত্যাগ এখানে ২২ জন শহীদ হয়েছে এবং সাড়ে তিনশ মানুষ আহত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে মামলাগুলোর তদন্তের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমি তাদের অনুরোধ করেছি চেষ্টা করুন পাঁচ আগস্টের আগে অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য। তারা জানিয়েছেন অনেক মামলায় তারা অভিযোগপত্র দিতে পারবেন।

উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করে বলেন, “অনেকে বলেছে ফ্যাসিস্টদের শক্তি মামলা করেছে এলাকায় যেতে দিচ্ছে না। আমি ডিসি ও এসপি সাহেবকে অনুরোধ করবো আপনারা তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবেন।” জনগণের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা জুলাইয়ে বিজয়ী হয়েছিলাম কারণ আমরা সকলে একটি পরিবারে পরিণত হয়েছিলাম। আমাদের এ ঐক্য ধরে রাখতে হবে।” স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তিনি জনগণকে জুলাইয়ের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান এবং প্রশাসন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তাঁর বক্তব্যে বলেন, “ছাত্র-জনতা দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছেন, বৈষম্যমুক্ত করেছেন। তাদের ত্যাগের মাধ্যমে আমরা নতুন দেশ পেয়েছি। এ জুলাইকে স্মরণ করে আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। জুলাইকে আমাদের সবসময় স্মরণ করতে হবে। নারায়ণগঞ্জে ৫৬ জন শহীদ হয়েছেন। বুলেটের সামনে সেদিন তারা বুক পেতে দিয়েছিল। এদের মধ্যে ২১ জন এ মাটির সন্তান। তাদের স্মরণে এবং তাদের পরিবার যে এতো বড় আত্মত্যাগ করেছে তা স্মরণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তারা এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জীবন দিয়েছিল। আর ওই উদ্দেশ্য হলো বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।”
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “তাদের শ্রদ্ধা করার একটি উপায় হচ্ছে দোষীদের বিচার কাজ নিশ্চিত করা। আর যেন বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের কোনো বাহিনী নিজ দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাতে না পারে। আমরা এ বিচার প্রক্রিয়া সামনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা শুধু নিহত করার বিচার নয়, মানুষকে অন্ধ করার, পঙ্গু করার বিচারও করবো। মোটকথা যারা যৌক্তিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করেছে সে বিচার আমরা সম্পন্ন করবো।”
তিনি আরও বলেন, “আন্দোলনকারীদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল তা হলো দেশকে বৈষম্যমুক্ত করা। আর এটি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এর আগেও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছিল। জুলাইতে যদি ছাত্র-জনতা বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে না দিতো, নির্ভীক না হতো তাহলে ৫ আগস্ট ঘটতো না।”

শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “বিভিন্ন জেলায় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণভবনকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাদুঘর গড়ে তোলার জন্য কাজ করা হচ্ছে। ৫ আগস্টের আগে এর উদ্বোধন করা হবে। এটা স্বৈরাচারের ঠিকানা। আমরা এ ঠিকানাকে সংরক্ষণ করতে চাই, দেখাতে চাই।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা উদ্যোগ নিয়েছি শহীদদের সমস্ত কবরগুলো সংরক্ষণ করার জন্য। আমরা কাজগুলো শেষ করতে চাই। তবে সংগ্রামের ধারা শেষ করতে পারবো এটা আপনাদের কাছে দিয়ে যাবো। আপনারা অগ্নিযুগের সন্তান, আগুন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। আপনারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে যেন কখনও কোনো আধিপত্যবাদী শক্তি চোখ রাঙাতে না পারে। ফ্যাসিবাদ না আসতে পারে। আসার চেষ্টাও করা হয় সেটাকে দমন করা হবে।”
উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বলেন, “এ সংগ্রামে বহু মানুষ গুম হয়ে যায়, বিচার বহির্ভূত নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। অনেক আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছিল। এ সংগ্রামের এক পর্যায়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, ছাত্ররা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে এবং অগ্নি কন্যারাও নেমে এসেছিলেন রাজপথে।”
এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরতে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) জাহিদুল ইসলাম মিঞা ও পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।

 
			




