লালন মেলার আয়োজনে হুমকি: ঘরোয়াভাবে আয়োজনে শঙ্কিত ভক্তরা
# দোকানদার সবাই চলে গেছে, বেশ আতঙ্কে আছি: ফকির শাহ জালাল
# এটা অবশ্যই নিন্দনীয় ও অপরাধমূলক কাজ: জিয়াউল ইসলাম কাজল
# লালন মেলা বন্ধের হুমকির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই: গণসংহতি
# লালন মেলা বন্ধের পায়তারা খুবই নিন্দনীয়: মুনা
# জেলা পুলিশ ও ফতুল্লা থানা পুলিশের ব্যবস্থা জোরদার: ওসি
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: লালন ফকির কারো মতে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক। কারো মতে, মানবতার অন্তরালে সর্বেশ্বরবাদী সুফি সাধক, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক। লালন অসংখ্য অসাধারণ গানের সম্রাট , সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূত বলা যায়। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাকে বাউল গানের সম্রাট হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার একটি গ্রামে লালন সাঁই স্মরণে ‘সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার’ আয়োজন করেছে লালন ভক্তরা। তবে এই অনুষ্ঠানকে নাজায়েজ আখ্যা দিয়ে বন্ধ করার হুমকি দেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল। তার এই বক্তব্যকে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের লোকজনসহ লালন ভক্তরা। । এদিকে, জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের অনুমতি মেলেনি। ফলে এ বছর সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঘরোয়াভাবে লালন মেলার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সকালে কাশীপুর ইউনিয়নের মধ্য নরসিংহপুর গ্রামে মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহ জালাল গণমাধ্যমকে এসব কথা জানান। এদিন বিকেল থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঘরোয়াভাবে দুইদিন ব্যাপি ‘সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার’ কার্যক্রম চলবে।
জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও ২২ ও ২৩ নভেম্বর দুই দিন ব্যাপী মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণে সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজনে থাকবে লালন স্মরণে ভক্তিমূলক গান, লালন সম্পর্কে আলোচনা ও খাবার বিতরণ। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লালন ভক্তরা এসে জড় হয়েছেন।
এ বিষয়ে মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহ জালাল বলেন, আমার নিজের জমিতে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানে গত ১০ বছর ধরে সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন করছি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লালন ভক্তরা এই আয়োজনে আসেন এবং লালনের গান চর্চা করেন। এখানে কোন ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড হয়না। তবে এবার মেলার কার্যক্রম বন্ধের হুমকি দিয়েছেন ডিআইটি মসজিদের খতিব ও হেফাজত নেতা মাওলানা আব্দুল আউয়াল। এমনকি মেলা বন্ধ না করলে সবকিছু ভেঙে ফেলবে বলে হুমকি দিয়ে আসছেন। ফোনে ও নানা লোকের মধ্যমে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। হুমকির মুখে মেলার দোকানদার সবাই চলে গেছে। এই অবস্থায় বেশ আতঙ্কের মধ্যে আছি।
তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে জানিয়েছি। প্রতি বছর জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে মেলার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। তবে এবার হেফাজত নেতার হুমকির পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লালন মেলার কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে ঘরোয়াভাবে আমরা অনুষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পন্ন করবো।
এর আগে,গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) কাশিপুর ইউনিয়নের মধ্য নরসিংহপুর ঈদগাহ মাঠে তৌহিদি জনতার ব্যানারে এক দল মুসল্লি নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল লালন মেলা বন্ধের হুমকি দেন। তার সেই হুমকি দেয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিডিও তে মাওলানা আব্দুল আউয়ালকে বলতে শোনা যায়, লালনের মেলা যদি আপনারা বন্ধ না করেন- আমরা প্রশাসনকে জানাবো এখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মুসলিম তৌহিদি জনতা অন্যায়ের ব্যাপারে কোন আপোষ করতে রাজি না। রসুল বলেছেন, কোনো নাজায়েজ বা অশালীন কাজ দেখলে হাত দিয়ে বাধা দিতে। প্রয়োজনে আমরা হাত দিয়ে বাধা দিবো। লালন নামীয় এখানে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ও অন্যায় অশ্লীলতা মদ, জুয়া, গাঁজা ইত্যাদি হবে সরকারও এগুলো পছন্দ করেনা।
এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখা, নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নিন্দা জানিয়েছেন।
তীব্র নিন্দা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজল বলেন, বিভিন্ন সময় ধর্মীয় ইস্যু তুলে তারা বাধা দিয়ে আসছে। এটা অবশ্যই নিন্দনীয় ও অপরাধমূলক কাজ।
গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখা নেতৃবৃন্দ জানান, গত ১৫ নভেম্ববর মুক্তিধাম আশ্রম আয়োজিত লালন মেলা বন্ধের হুমকির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। গত ১৭ সেপ্টম্বর স্থানীয় প্রাসাশন কাশিপুর, নরসিংহপুর গ্রামের মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমিকে লালন মেলা করার অনুমোদন প্রদান করেন। কিন্তু ১৫ তারিখ তৌহিদী জনতার নাম ব্যবহার করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টিকারীরা হুমকি দিয়ে লালন মেলা বন্ধ করতে বলেন। সেই সাথে তারা প্রয়োজনে হাত ব্যবহার করবেন বলে জানান। যা নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার মতো ফৌজদারি অপরাধ।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাউল, সন্ন্যাসী, আদিবাসী, বাঙালী সকলে একসাথে মিলেমিশে আমরা বসবাস করি। আমাদের সম্প্রীতি আমাদেরকে শক্তির যোগান দেয়। কাশিপুর ইউনিয়নের অনুষ্ঠিত লালন মেলা বন্ধের পায়তারা এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা খুবই নিন্দনীয় বলে আমরা মনে করি। নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য সকল ধর্মমতের সহাবস্থান আমাদেরকে বজায় রাখতে হবে। আমরা জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে আহ্বান করবো আপনারা অতিদ্রুত এর ব্যাবস্থা নিবেন। অন্যথায় অপ্রীতিকর ঘটনার দায়ভার প্রশাসনকেই নিতে হবে।
ফতুল্লা মডেল থানার ইন্সপেক্টর (অফিসার ইনচার্জ) শরিফুল ইসলাম লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ঘরোয়াভাবে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছে। কোন মেলা হচ্ছেনা। তবুও যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটতে পারে। সেজন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ ও ফতুল্লা থানা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আমাদের পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে আছেন।