বুধবার, জুলাই ১৬, ২০২৫
Led01অর্থনীতিবিশেষ প্রতিবেদন

বৃষ্টিতে সবজির অগ্নিমূল্যে, কূলহারা খেটে খাওয়া মানুষ

# প্রশাসন শুখা বাজারে আসে, বর্ষায় নাই: ক্রেতা
# বৃষ্টি শুরু অইলেই মাল টানা কষ্টকর, এই জন্যে দাম বারে: বিক্রেতা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: আকাশ ফুঁড়ে জল নামছে তো নামছেই। ভারী বর্ষণ জনজীবন ভাসিয়ে দিলেও, নারায়ণগঞ্জের কাঁচাবাজারের চিত্রটা ভিন্ন। এখানে যেন চলছে অন্যরকম এক আগুন খেলা, সবজির দামে যা ঝলসে দিচ্ছে সাধারণের পকেট। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ, পেটে ক্ষুধা, আর মনে শুধুই অসহায়ত্ব। বৃষ্টির ছাঁটে শরীর ভিজলেও, বাজারের তেজে পুড়ছে মন! শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি বাজার যেন আজ এক নীরব হাহাকারের মঞ্চ। খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে সামান্য বেতনের চাকুরিজীবী, সবার চোখেমুখে একই প্রশ্ন—আর কত বাড়বে এই দাম? কবে মিলবে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি?

“কেনার সাধ নাই, ভাই!”
নারায়ণগঞ্জের আনাচে-কানাচে এখন একটাই কথা, “আহারে, দাম দেইখা মেজাজ গরম অইয়া যায়!” বাজারে পা রাখতেই চোখে পড়ে সেই পরিচিত দৃশ্য—কষ্ট করে একটু আধটু সবজি কিনছেন কেউ কেউ। তবে অধিকাংশের পক্ষেই ইচ্ছেমতো সবজি কেনা এখন স্বপ্ন। “কি কমু ভাই? এক পাও সবজি কিনতে গেলে কলিজা কাঁপে!” দিগু বাবুর বাজারের এক দিনমজুরের আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে ফুটে ওঠে চরম বাস্তবতা।

আজকের বাজারদর অনুযায়ী, বিভিন্ন সবজির দাম প্রতি কেজিতে যা দেখা গেছে, তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো, শসা ৫০-৬০ টাকা, ক্যাপসিকাম: ৩০০ টাকা, ধনে পাতা: ২৪০ টাকা, পুদিনা পাতা: ৩০০ টাকা, গাজর: ৮০-১৪০ টাকা, টমেটো: ১৪০ টাকা, পেঁপে: ৩০-৪০ টাকা, বরবটি: ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ: ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, লাউ: ৩০-৪০ টাকা (আকারভেদে), করোলা: ৬০ টাকা, ঢেঁড়শ: ৩০ টাকা, পটল: ৪০ টাকা, কাঁকরোল: ৫০-৪০ টাকা, বেগুন: ৬০ টাকা, গোল বেগুন: ১২০ টাকা, বাঁধাকপি: ৮০ টাকা, প্রতি কেজি পুঁইশাক ৪০ টাকা, লালশাকের কেজি ৩০ টাকা ও মিষ্টিকুমড়া ৪০ টাকা।

মাংসের বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকা কেজি, সোনালি মুরগি ২৮০-২৯০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৮০-৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজি এবং খাসির মাংস ১১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

“কী করুম ভাই, মাল আয়ে না!”
অন্যদিকে, বিক্রেতারা নিজেদের অসহায়ত্বই তুলে ধরছেন। এক সবজি বিক্রেতা বলেন, “ভাই, কী করুম কন? রাস্তাঘাটে সব পানি, মাল আইয়ে না ঠিকমতো। ক্ষেত থাইক্যা তুলতেই খরচ বেশি পড়ি যায়। যা আইয়ে, হেইয়াও সব তাজা থাহে না।”

আরেক বিক্রেতা সজিব মিয়া বলেন, “আমাগোও তো লাভ অইতে অইবো ভাই। যে গাড়ি ভাড়া লাগে আর মাল নষ্ট অয়, হেইয়া পোষাইতে তো দাম বাড়াইতে অয়। আমাগো কি হাত-পাও বাঁধা না কি?”

সাগর নামে এক তরুণ বিক্রেতা বলেন, “হামার তো বাপ-দাদার আমলোত এমন দেখিনু না। বৃষ্টি শুরু অইলেই মাল টানা কষ্টকর। এই জন্যে দাম বারে।”

মাছের বাজারেও ‘বিলাসিতা’: “গরীবের পাতে মাছ নাই!”
শুধু সবজি নয়, বৃষ্টির দিনে মাছের দাম কম থাকার কথা থাকলেও নারায়ণগঞ্জের দিগু বাবুর বাজারের চিত্র ভিন্ন। এখানেও মাছের দাম চড়া।

গলাচিপা থেকে অনিক নামের এক ক্রেতা জানায়, “ভাই, মাছের বাজার দেখলেই বুকটা ধুক কইরা ওঠে। একখান ছোট মাছের দামও এত বেশি যে নিম্নবিত্তদের জন্য মাছ খাওয়া এখন বিলাসিতার মতোন! আমাগো মতোন গরীবের পাতে আর মাছ জুটবো না,”। মধ্যবিত্তরা হয়তো কিছু মাছ কেনার সামর্থ্য রাখলেও, নিম্নবিত্তদের জন্য তা যেন অলীক স্বপ্ন।

এদিকে, আজকের বাজারদর অনুযায়ী মাছের বাজারে, কই মাছ ২০০-২৫০ টাকা কেজি, রুই মাছ ৩০০-৪০০ টাকা, টেংরা ৫০০-৬০০, পাবদা ৪৫০-৫০০, চিংড়ি ৬০০-৭০০ টাকা, ছোট মাছ ৩০০-৪৫০টাকা, তেলাপিয়া ২০০-২৫০ টাকা, ভেটকি মাছ ৪০০-৫০০ টাকা এবং পাঙাস মাছ ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে।

“শুখা বাজারে আসে, বর্ষায় নাই!”
ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। তাদের মতে, যখন বৃষ্টিতে মানুষের চরম দুর্ভোগ, সবজির দাম আকাশছোঁয়া, তখন প্রশাসনের কোনো নজরদারিই নেই।

শারেফ আহম্মেদ নামে এক ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, “এই যে বৃষ্টিতে আমাদের জীবন শেষ, বাজারে আগুন, কই কোনো তদারকি তো নাই! যখন বাজার শুকা থাকে, সবজির দাম কম থাকে, তহন আসে নজরদারি করতে। এইটা কেমন বিচার।”

নারায়ণগঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মম চিত্রই নয়, এটি অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা এবং নাগরিক সেবার দুর্বলতাকেও স্পষ্ট করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে।

RSS
Follow by Email