বুধবার, অক্টোবর ৮, ২০২৫
Led02অর্থনীতিফতুল্লা

ফতুল্লায় নিরাপত্তা প্রহরীকে বর্বর নির্যাতন, পুলিশি হস্তক্ষেপে উদ্ধার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: আলো ঝলমলে শিল্পাঞ্চল, যেখানে রাত-দিন চলে অর্থনীতির চাকা। সেই চাকা সচল রাখতে যিনি রাতের আঁধারে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় থাকেন, এবার তিনিই হলেন পৈশাচিক হামলার শিকার। তুচ্ছ এক ‘চোর’ অপবাদ এবং সামান্য বাগ্‌বিতণ্ডার সূত্র ধরে সৈকত নীটওয়্যার লিমিটেডের এক তরুণ নিরাপত্তাকর্মী লিয়ন ইসলাম (২১)-কে অপহরণ করে নির্মমভাবে মারধর করেছে দুর্বৃত্তের দল। ঘটনাটি ঘটেছে ফতুল্লার কোতালের বাগ এলাকায়। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের দ্রুত হস্তক্ষেপে লিয়নকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের নিরাপত্তা কি এতটাই নড়বড়ে?

নিরাপত্তা প্রহরী লিয়ন ইসলাম গত দুই মাস আগে সৈকত নীটওয়্যার লিমিটেডে যোগদান করেন। নিয়ম অনুযায়ী, গত ৪ অক্টোবর রাত ১০টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিল। সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল, কিন্তু ৫ অক্টোবর রাত আনুমানিক সাড়ে ৩ টায় ফ্যাক্টরির বাইরে একটি বসতবাড়ি থেকে ‘চোর-চোর’ চিৎকার শুনতে পান লিয়ন।

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিশ্চিত হতে তিনি টর্চলাইট মেরে এগিয়ে যান। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। তার টর্চলাইট দেখে পার্শ্ববর্তী বাড়ি থেকে ১ থেকে ৪নং বিবাদী— শাওন (২২), সাব্বির (১৮), মিরাজ আহমেদ (২০) এবং সোহেল (২২)— তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘চোর’ বলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। লিয়ন কোনো উত্তর না দিয়ে নিরবতা অবলম্বন করেন, হয়তো পরিস্থিতি শান্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই নীরবতাই কাল হলো।

প্রথমদিনের ঝামেলা এড়িয়ে গেলেও দুর্বৃত্তরা যেন প্রতিশোধের জন্য ওঁত পেতে ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর ভোরে ডিউটিতে যোগ দেওয়ার জন্য লিয়ন যখন পিঠালীপুল থেকে অটোরিকশা যোগে সকাল পৌনে ৬টায় কাঠেরপুল আবির ফ্যাশন সংলগ্ন মান্নান মসজিদের সামনে রাস্তার উপর পৌঁছান, তখনই ঘটে মূল ঘটনা।

বিবাদী শাওন, সাব্বির ও মিরাজ মিলে নিরাপত্তা প্রহরী লিয়নকে কৌশলে একটি অজ্ঞাতনামা অটোতে উঠিয়ে নেয়। এরপর তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় ফতুল্লার পূর্ব লামাপাড়া নম পার্কের নিকটস্থ কভারভ্যান ও ট্রাক রাখার স্ট্যান্ডের পিছনে একটি নির্জন স্থানে।

সেই নির্জন স্থানে লিয়নকে অন্যায়ভাবে আটক রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর ৪ ও ৫ নম্বর বিবাদী— সোহেল এবং ইয়াসিন আরাফাত (২৪)— সেখানে যোগ দেয়। এরপর পাঁচজন মিলে লিয়নকে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথাড়ি মারপিট শুরু করে করে বলে জানান ভূক্তভোগী লিয়ন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলা-ফোলা জখম হয়। মারধরের এক পর্যায়ে ১নং বিবাদী লিয়ন ইসলামের রেডমি স্মার্ট ফোন ছিনিয়ে নেয়। মারধরের সময় তাকে বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি ও জীবননাশের হুমকিও দেওয়া হয়।

এদিকে, নিরাপত্তা প্রহরী লিয়নকে না পেয়ে সৈকত নীটওয়্যার কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্থানে তার খোঁজ শুরু করে। অন্যদিকে, কিছু লোকজন মারধরের এই ঘটনা দূর থেকে দেখে দ্রুত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করেন। সংবাদ পেয়ে সকাল আনুমানিক ৭টার সময় ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের একটি টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুর্বৃত্তরা দ্রুত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পুলিশ লিয়ন ইসলামকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এবং নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমরা ৯৯৯ জরুরী সেবায় ফোন পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে নিরাপত্তা প্রহরী লিয়নকে উদ্ধার করি। এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের মধ্যে ৩জনকে আটক করা হয়েছে। আমরা দ্রুতই এর সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।

এই ঘটনায় সৈকত নীটওয়্যার লিমিটেড তাদের একজন কর্মীর এমন দুর্দশায় গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই লিয়ন ইসলামের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং দ্রুত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

এ বিষয়ে সৈকত নীটওয়্যার লিমিটেডের মালিক সৈকতের পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ঘটনার দিন নিরাপত্তা প্রহরী লিয়নের অনেক খুঁজাখোজি করি কিন্তু তাকে কোথায় পাওয়া যায়নি। প্রথমে মনে করেছিলাম অসুস্থতা জনিত কারণে সে কর্মস্থলে আসতে পারেনি। তাই তাৎক্ষনিক অন্য একজনকে তার জায়গায় ডিউটি করাই। কিন্তু পরে দুপুরে ঘটনার সম্পর্কে জানতে পারি। আমাদের সৈকত নীটওয়্যার সর্বপ্রথম কর্মীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। তাদের সুরক্ষা দেয়া আমাদের একমাত্র অন্যতম কাজ। তাই আমরা ঘটনার পর পরই ফতুল্লা থানার সাথে যোগাযোগ করে আইনী সহায়তা চেয়েছি। আইনের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। জরুরী ভিত্তিতে অভিযুক্তদের আইনের আওয়াত নিয়ে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছি যাতে কখনো আমাদের শ্রমিকদের এমন পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়, সে বিষয়ে আমরা আরও কঠোর ভূমিকা পালন করবো। আমরা চাই দ্রুত এর বিচার হোক।

জানা গেছে, প্রয়োজনীয় নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর লিয়ন ইসলাম নিজেই ফতুল্লা মডেল থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। পুলিশ দ্রুত এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্ত শুরু করেছে।

RSS
Follow by Email