না.গঞ্জে রঙিন সাজে তাজিয়া, দেখা মিলবে প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য
# ‘বাপ-দাদার আমল থেকে তাজিয়া মিছিল করে আসছি’
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: বাঁশ, কঞ্চি ও কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ঘরের অবয়ব। ঘরের চারপাশে ককশিট দিয়ে পেচানো হচ্ছে রঙিন কাপড়। সবুজ, বেগুনী, সাদা রঙের কাপড়ে সাজানো হচ্ছে তাজিয়া, মহানবী (সা.) এর নাতী হোসেনের প্রতীকী কবর। তাজিয়া বহনের জন্য তৈরী করা হয়েছে কার্টন ও কাঠের তৈরী স্টেজ। স্টেজের চারপাশে পালকির মতো করে ৪ জন বহন করার মতো বাঁশ সাটানো হয়েছে। একদিনের মধ্যেই সুন্দর করে নকশা করে সাজানো হবে তাজিয়া। আশুরার দিনে সেই তাজিয়া কাঁধে নিয়েই বেরোবে শোকের মিছিল। ইয়া হোসেন, ইয়া হোসেন ধ্বনিতে মুখরিত হবে নগরীর ওলি গোলি- নারায়ণগঞ্জে এভাবেই প্রায় দেড়শ বছর ধরে তাজিয়া মিছিল বেরোচ্ছে।
হিজরি সালের ১০ মহররম আশুরার দিন বলে বেশ আলোচিত। এ দিন ঘটে যাওয়া নানা হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিমদের মর্মাহত করেছে। ঘটনাবহুল এই দিনে বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কারবালা প্রান্তরে মুয়াবিয়ার হাতে শহীদ হন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.)। তাঁর মৃত্যুর দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন মুসলিমরা। এ দিনে শিয়াপন্থী ও মুসলিমদের একাংশ কাধে করে তাজিয়া নিয়ে পথে ঘাটে শোকের মিছিল বের করে। মিছিলের সাথে সিন্নি বিতরণ ও সরবত ফাতেহের আয়োজন করা হয়। তারা বিশ্বাস করেন, ইমাম হোসেন (রা.) যখন কারবালার ময়দানে শহীদ হন, তখন তার মা ও মহানবী (স.) এর কন্যা ফাতেমা (রা.) ছেলেকে দেখতে অদৃশ্যভাবে ছুটে আসেন কারবালায়। তিনি এসে তার শহীদ সন্তান ইমাম হোসাইনকে দেখে যান। একে বলা হয় ‘মারেফত’। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মহররম মাসের ১০ তারিখ তথা আশুরার দিনকে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে পালন করেন তারা।
প্রতিবারের ন্যায় নারায়ণগঞ্জে এবারও তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। নগরীর মন্ডলপাড়া, কুমুদিনি এলাকার রিলে বাগান, দেওভোগ ও মেট্ট্রোহল থেকে প্রতিবছর তাজিয়া মিছিল বের হয়। স্থানীয়দের মতে, দাদা-নানার আমল থেকে এসকল এলাকায় তাজিয়া মিছিল সবাই দেখে আসছে। যা প্রায় দেড়শ বছর আগ থেকে হবে। এসকল এলাকায় তাজিয়া মিছিল শীয়াপন্থীদের থেকে অনেকটা ভিন্ন। এখানে, বিশ্বাস করা হয়, ‘ইমাম হোসেন, মা ফাতেমা, মহানবী এখনো জীবিত।’ তাই তো তাজিয়া মিছিলে শীয়াদের- হায় হোসেন, হায় হোসেন- প্রতিধ্বানির পরিবর্তে -ইয়া হোসেন, ইয়া হোসেন- প্রতিধ্বনি উচ্চরিত হয়।
নিতাইগঞ্জের খয়ের পট্টি এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের একটি অংশে তেরপাল লাগিয়ে বাঁশ, কাঠ, পেরেক, ককশিট ও বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে তাজিয়া। এই কাজে কারিগরদের সাথে হাত বাড়াচ্ছে ছোট-বড় সকল বয়সের মানুষ। জানা যায়, নিতাইগঞ্জ ইমাম হোসা্ইন কমিটি (পাক পঞ্জাতন) তদারকিতে তাজিয়া প্রস্তুত করা হচ্ছে।
কমিটির সভাপতি ও খয়ের পট্টি এলাকার বাসিন্দা আরমান লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষ, দাদা, নানা তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করে আসছে। এবারের তাজিয়া মিছিল আমাদের ১৪০তম ওরশ। সেই ঐতিহ্য আমরা ধরে রেখেছি। এই এলাকায় এবং আশেপাশে থেকে যে যা সাহায্য করে সেই নিয়েই ১০ই মহররম তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করি। কোন খোলা জায়গা না থাকায় সড়কের এক পাশে তাজিয়া তৈরীর কাজ হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ শহরে তাজিয়া মিছিল শিয়াদের থেকে ভিন্ন বলে আরমান বলেন, আমাদের অনেকেই শিয়া বলে কিন্তু শিয়া আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। ওরা তাজিয়া মিছিলে নিজেদের আঘাত করে আর হায় হোসেন বলে শোক পালন করে। কিন্তু আমরা এখনো আমাদের ইমাম হোসেন কে জীবিত মনে করি তাই ইয়া হোসেন বলি। আমাদের বিশ্বাস ইমাম হোসেন, মা ফাতেমা, মহানবী এখনো জীবিত আছেন। আর তাই আমাদের এই মিছিল। আমরা শুধু তাজিয়া মিছিল করি আর কিছু সিন্নির আয়োজন করা হয়। তবে আমাদের এই আয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই করা হয়। আমরাদের প্রশাসন বা সিটি করপোরেশন এর পক্ষ থেকে অনুদান দেওয়া হয় না, তারা মিছিলে সার্বিক নিরাপত্তা দেয়। এই তাজিয়া মিছিলের জন্য আমাদের প্রতিবছর লাখ খানেক টাকা খরচ হয়। আমাদের এই আয়োজনে জামিল আহমেদ ক্যাপ্টেন সহ আরও অনেকে সব সময় সহযোগিতায় থাকে।
মেট্রোহল এলাকায় তাজিয়া মিছিলের আরেকজন আয়োজনকারী রাজন বলেন, সাধারণত ৯ মহররম বাদ মাগরিব প্রথম মিছিল হয়। মুসলিমরা হেঁটে হেঁটে সারা নগরীতে এই মিছিল করে। আশুরার এদিন মিছিল ঘোড়াও থাকে তাদের দুলদুল ঘোড়া বলা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ঘোড়া নিয়ে মিছিল বা পিঠে আঘাত করে মাতম করা হয় না। এটা শিয়ারা করে। আমাদের তাজিয়া মিছিলের প্রতীক থাকবে একটি ঘর। আর সেই ঘরের ভেতর ইমাম হাসান ও হোসেনের প্রতীকী কবর থাকবে। আর সবার হাতে থাকবে নিশান। তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সারা দেশে শত শত বছর ধরে ইমাম হোসেন (রা.) শহীদ হওয়ার দিনটিকে ঘিরে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এ মিছিল মূলত শোক মিছিল। তার মৃত্যুতে শোক জানাতেই প্রতিবছর তাজিয়া মিছিল বের হয়। সেদিন মিছিল দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। আমাদের কমিটিতে মেহেদী, সায়েম, প্রশান্ত, মাঈনউদ্দিন, মনির, শাহীনসহ আরও অনেকেই এই মিছিলে প্রতিবছর সহোযোগি হিসেবে থাকেন।
এদিকে, আশুরা উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোঃ আমীর খসরু বলেন, আমরা সবসময় নিরাপত্তা চাদরে না.গঞ্জকে ঢেকে রাখি। তবে যেহেতু আশুরার বা ১০ই মহররম মুসলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, তাই এটি উপলক্ষে আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন থাকবে। আমরা সারা নারায়ণগঞ্জে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের এসপি স্যারের নির্দেশনায় যে কোন অবস্থার জন্য আমরা সর্বক্ষন মোকাবেলার জন্য তৈরি আছি।