না.গঞ্জে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দূর্গার বিদায়
# মন্ডপের মনমুগ্ধকর আয়োজন দেখে দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের মুখে প্রশংসা
# সার্বিক নিরাপত্তায় কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়েছেন ভক্তকূল। মর্ত্যে ‘বাবার বাড়ি’ বেড়ানো শেষে ঘোড়ায় চড়ে ‘কৈলাসে দেবালয়ে’ ফিরেছেন আনন্দময়ী দেবী দুর্গা। মায়ের কাছে অশুর শক্তির বিনাশের প্রার্থনা করেছেন ভক্তরা। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি ও উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব।
রবিবার (১৩ অক্টোবর) দেবীর বিদায়ের পূর্বে মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন নারীরা। সকাল থেকে দেবী দুর্গার চরণের সিঁদুর নিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে তোলেন তারা। নগরীর রামকৃষ্ণ মিশন, আমলাপাড়া পূজা মন্ডপ, সাহাপাড়া পূজা মন্ডপ, নতুন পালপাড়া পূজা মন্ডপ, নতুন নয়া মাটি পূজা মন্ডপসহ বেশ কিছু মন্ডপে চলে ভক্তদের আরতি ও রঙের হোলি খেলা। পরম ভক্তি নিয়ে নিজ নিজ মনের বাসনা জানিয়ে নারীরা দেবী দুর্গার সিঁথিতে সিঁদুর পরান এবং মিষ্টি মুখ করান। পরে মন্দিরে আগত নারীরা একে অপরের সিঁথিতে সিঁদুর বিনিময় করেন। এরপর বিসর্জনের জন্য সধবা নারীরা দেবীকে সাজান ফুল, সিঁদুর ও নানা অলঙ্কার দিয়ে। একদিকে দেবীকে বিদায়ের বিষাদ অন্যদিকে, সিদুর খেলার আনন্দ। সকল পূজা মন্ডপগুলোতে যেন বিষাদ-আনন্দের মিশ্র অনুভূতি বিরাজ করে। প্রতিমা বিসর্জনে বিকেল থেকেই বিভিন্ন মন্ডপগুলো থেকে প্রতিমা বের করা শুরু হয়। বিসর্জন দিতে নানান রকমের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভক্তরা।
ট্রাক ও ভ্যানে করে প্রতিমা নিয়ে বিভিন্ন মন্ডপ থেকে আনন্দ শোভা বের হয়। এ শোভাযাত্রায় ভক্তদের নাচ-গানে মুখর হয়ে উঠে চারপাশ। রং ছিটিয়ে ও ঢাকঢোল, বাঁশিসহ নানান বাদ্যযন্ত্রের সাথে উলুধ্বনিতে পরিবেশ উৎসবমুখর করে তোলেন। শোভাযাত্রাগুলো নগরীর বিআইডব্লিউটিএ‘র ৩নং ঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়।
সন্ধ্যার পর থেকে নগরীতে শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রতিমা বির্সজন দেওয়া শুরু হয়। একই সময়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া শুরু হয়। নগরীর বিআইডব্লিউটিএ‘র ৩নং ঘাটে প্রশাসন-পুলিশের নিরাপত্তায় এবং নারায়ণগঞ্জ পূজা উদযাপন পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার আয়োজন করা হয়। এ ঘাটে প্রথমে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্ডপের প্রতিমা বিসজর্ন দেওয়া হয়। একে একে বিভিন্ন মন্ডপ থেকে শোভাযাত্রা এসে, ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়।
এসময় জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিপন সরকার শিখন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) তরিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসি নজরুল ইসলামসহ র্যাব, বিজিবি, আনসার, কোস্ট গার্ড, নৌ-পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস। সেই সাথে ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট এবং বিভিন্ন পূজা মন্ডপের ভলানটিয়াররা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও, সেনাবাহিনীর একটি দল চারদিক টহলরত অবস্থায় ছিলেন।
প্রতি বছর নগরীর বেশিরভাগ পূজা মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন এই ঘাটে দেওয়া হয়। প্রতিমা বিসর্জন দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই প্রতিমা বিসর্জন।
এবছর দুর্গোৎসব উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে ২১৪টি পূজা মন্ডপের আয়োজন করা হয়। এবার শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি দুর্গোৎসব উদযাপিত হয়েছে। উৎসবে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে। সেনাবাহিনী, র্যাব, আনসার, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী প্রতিটি পূজা মন্ডপের নিরাপত্তায় কঠোর অবস্থান নেয়। এছাড়াও যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেও তারা প্রস্তুত ছিলেন। রবিবার প্রতিমা বিসর্জনের জন্য জেলার বিভিন্ন ঘাটে নৌ-পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস তৎপর ছিলেন।
দুর্গোৎসবে নারায়ণগঞ্জের পূজা মন্ডপ পরিদর্শনে এসেছিলেন পুলিশের আইজিপি ময়নুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান এবং ভারতীয় হাইকমিশনের গকুল ডিকে। সেই সাথে পূজা মন্ডপ দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশী দর্শনার্থীরা নগরীসহ জেলার বিভিন্ন পূজা মন্ডপে ভিড় জমান। মন্ডপে মনোমুগদ্ধকর আয়োজন দেখে প্রত্যেকেই দুর্গোৎসব নিয়ে প্রশংসা করেন।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যারূপে’ মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।
মহালয়ার মধ্য দিয়ে গত ২ অক্টোবর দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনা ও আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর গত বুধবার ষষ্ঠী থেকে পাঁচ দিনের যে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, রবিবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এ আয়োজন শেষ হয়। এর মাঝে বৃহস্পতিবার নবপত্রিকায় প্রবেশ ও স্থাপনে হয় মহাসপ্তমী। পরদিন শুক্রবার সকালে কুমারী পূজার পাশাপাশি মহাঅষ্টমীর বিহিত পূজা ও সন্ধিপূজা হয়। আর তিথির কারণে একই দিনে গত শনিবার দুর্গোৎসবের মহানবমী ও দশমী পূজা হয়েছে। এরপর থেকে মায়ের বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করে। অবশেষে রবিবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য নিয়ে বিদায় নেন দেবী দূর্গা।