না.গঞ্জে জিয়া হল ও ৬ দফা ভবন বিতর্ক প্রসঙ্গ
রফিউর রাব্বি: ইতিহাসকে পক্ষে নেয়ার রাজনৈতিক প্রয়াস নতুন নয়। কালে কালে দেশে দেশে তা হয়েছে। তবে আমরা সম্ভবত এই চর্চায় সবচেয়ে বেশিই অগ্রসর। কিন্তু রাজনৈতিক মিথ্যাচার সাময়িক বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেও আখেরে তা টেকে
না। নিজেকে উচ্চাসনে সমাসিন দেখানোর জন্য অতীত সম্পর্কে ভুল—ভাল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা শামীম ওসমানের নতুন নয়। কখনো এ বিষয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু নিরবতা কখনো কখনো অন্যায়ের পর্যায়েও পড়ে। নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যায়, আর সেজন্যই এই লেখার অবতারণা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সাংসদ শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের ‘জিয়া হল’কে ‘৬ দফা ভবন’ করার দাবি জানিয়ে কিছু ভুল তথ্য হাজির করেছেন। মিলনায়তনের নাম জিয়া হল বা ৬ দফা ভবন নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। শামীম ওসমান দাবি করেন নারায়ণগঞ্জের বালুরমাঠটি ৬ দফার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে, পরে জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া সে ইতিহাস মুছে দেয়ার জন্য সেখানে ‘জিয়া হল’ নির্মাণ করেছেন। এ দাবিটি সর্বৈব অসত্য। আলোচিত স্থানটিতে মিলনায়তন করার দাবিটি উত্থাপিত হয় ১৯৫৬ সালে; আর এই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা দাবির পক্ষে ভাসন দেন ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে। আর ৬ দফার দাবি এখানে প্রথম তোলাও হয় নাই। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলেীর বাসবভনে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশে প্রথম ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে তিনি ৬ দফা ব্যাখ্যা করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় ৬ দফা তুলে ধরেন। ১৮ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ১৬ পৃষ্ঠার পুস্তিকা আকারে তা বিলি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের বালুরমাঠে বঙ্গবন্ধুর সমাবেশটি হয় ৮ মে। সেখানে তিনি ৬ দফার পক্ষে বক্তৃতা করেন। এবং ঢাকায় ফিরে ঐ রাতেই তিনি গ্রেপ্তার হন।
নারায়ণগঞ্জে নাট্য—কর্মীরা নাটক মঞ্চায়ন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নারায়ণগঞ্জে স্থায়ী একটি মিলনায়তন নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন ১৯৫৬ সালে। তৎকালীন স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক আবদুস সাত্তার এ দাবির সাথে একাত্ম হয়ে
নারায়ণগঞ্জে একটি টাউনহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। চাষাঢ়ার এই বালুরমাঠে টাউনহল নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। অর্থায়নের জন্য বর্তমান ডায়মণ্ড সিনেমা হলে সপ্তাহ ব্যাপী নাটক প্রদর্শিত হয়। সাতদিনে তিনটি বাংলা ও একটি উর্দু নাটক প্রদর্শিত হয়। নাটকগুলো পরিচালনা করেন কাজী খালেক, আলী মনসুর, জলিল আফগানী ও আলী কাওসার। এতে অভিনয় করেন কাজী খালেক, ইনাম আমহমেদ, মফিজুল ইসলাম, আবদুর রউফ, বিলকিস বারী, আনোয়ারা, পূর্ণিমা, মিনতি, নিনা হামিদ, নূর জাহান সহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন শিল্পী। এ প্রদর্শনী থেকে ৯৬ হাজার টাকা সংগৃহিত হয়। এ নাট্য—সপ্তাহ আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন আবদুর রউফ, স্মৃতিময় বন্দোপাধ্যায়, বশির আহমেদ প্রমুখ নাট্যকর্মীবৃন্দ। আর সে সময় টাউন হল নির্মাণের জন্য উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক, কয়েকজন মেজিষ্ট্রেট এবং নারায়ণগঞ্জের হাবিব করিম, কফিলউদ্দিন আহাম্মদ, তৈয়ব কাপাটিয়া, গোলাম রব্বানী, রেজাউর রহমান প্রমুখ। কিন্তু টাউন হল নির্মাণের কাজ শুরু করা যায় নি। পরে ষাটের দশকের শুরুতে আবার টাউন হল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময়ও তা কার্যকর হয় নি। তখন শুধুমাত্র জায়গা ক্রয়ের জন্য ডিআইটিতে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
স্বাধীনতার পর আবার নতুন করে টাউন হল নির্মাণের তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আবদুল হাই সরকার পাঁচ লক্ষ টাকার তহবিল সংগ্রহ করে টাউন হলের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৭ সালের ৮ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নারায়ণগঞ্জ পৌর মিলনায়তনে এলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ চাষাঢ়া বালুর মাঠে ‘টাউন হল’ নির্মাণ এবং একটি হাসপাতাল তৈরির দাবি জানান। সে সভাতেই জিয়াউর রহমান এই প্রতিষ্ঠান দু’টি করে দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দেন এবং তখনই তিনি প্রশাসনকে টাউন হল নির্মাণের নির্দেশ দেন। সে বিষয়ে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এ.এফ.এম. ইমাম হোসেন, জেলা প্রশাসক এ.এম. শওকত আলী, বিভাগীয় কমিশনার এম. খানে আলম খান এবং নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জিয়াউর রহমান সে বছরই টাউন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২৫ লক্ষ ২০ হাজার ৯২০ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এছাড়াও আনুসাঙ্গিক অন্যান্য ব্যায়ের জন্য আরও ১০ লক্ষ ৩৫ হাজার ৬৫৯ টাকা ছাড় করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু সে বছর ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সরকার মিলনায়তনটির নাম ‘শহীদ জিয়া হল’ করে। হল নির্মাণ বা পরে এর নামকরণ নিয়ে কখনো কোন প্রতিবাদ, অপ্রীতিকর ঘটনা তখন বা পরে কখনো ঘটে নি, কেউ কখনো এ ব্যপারে জেলেও যায় নি। এ বিষয়ে শামীম ওসমানের প্রতিবাদ করার দাবি ভিত্তিহীন।
এই জিয়া হলটি শুরু থেকে স্থানীয় মহকুমা ও পরে জেলা প্রশাসক দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে। বিগত একযুগ ধরে এ হলটি সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী। কিন্তু কখনোই এই হলটি সাধারণের ব্যাহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে এরশাদের শাসনামলে দীর্ঘ দিনই বলা চলে এইটি সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ থেকেছে। পরে এরশাদ শাসনের অবসান হলেও এইটি স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত হয় নাই। বিভিন্ন সময় সরকারী অনুষ্ঠান ব্যতিত শুরু থেকেই এই হলটি ছিল সাধারণের অধিকারের বাইরে। নামের কারণে আওয়ামী লীগের বিশ বছরের শাসনামলে এইটি উপেক্ষিত থেকেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এই হলটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন’ নামে সরকারের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও এইটি স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। শুরু থেকে এই হলটি রাজনৈতিক বৃত্তের চক্রে যে ভাবে আবদ্ধ হয়েছে তা নারায়ণগঞ্জে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির দুষ্ট চক্র থেকে মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: রফিউর রাব্বি, সাংস্কৃতিক সংগঠক