নারায়ণগঞ্জের ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশির আগ্রাসন
# স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি: মেডিকেল অফিসার নাফিয়া
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: দিগন্তজুড়ে মেঘের ভেলা, অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ – বর্ষা যখন তার রূপ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে হাজির হয়, তখন প্রকৃতি যেমন অপরূপ সাজে সেজে ওঠে, তেমনই এই ঋতু নিয়ে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ। এখানকার প্রতিটি ঘরে এখন বাড়ছে এক অলক্ষ্য আতঙ্কের রেশ – মৌসুমি জ্বরের প্রকোপ। শিশু থেকে প্রবীণ, কোনো বয়সের মানুষই এই জ্বর, সর্দি আর কাশির থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্টের মতো গুরুতর উপসর্গও, যা বাড়িয়ে তুলেছে উদ্বেগ। স্থানীয় হাসপাতাল আর চিকিৎসকদের চেম্বারগুলোতে এখন রোগীর দীর্ঘ সারি, আর পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্যদের মধ্যেও, যা নারায়ণগঞ্জের জনজীবনে তৈরি করছে এক চাপা অস্থিরতা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা এই সমস্যার নেপথ্যে আবহাওয়ার তারতম্য এবং ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বাড়াবাড়ন্তকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বর্তমান আবহাওয়া – কখনও বৃষ্টি, কখনও ভ্যাপসা গরম, আর তার সঙ্গে বাড়তে থাকা আর্দ্রতা – ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলেই সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে।
চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্তমানে অধিকাংশ রোগীই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ারের চিকিৎসক সৌতিক পাণ্ডা জানাচ্ছেন, প্রায় প্রতিদিনই এক-দু’জন করে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ’ পজ়িটিভ রোগী মিলছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, শিশু, বয়স্ক ও কোমর্বিডিটিতে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে যথাযথ চিকিৎসা না করলে সমস্যা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জার নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি রয়েছে, যা প্রয়োজনে দ্রুত শুরু করা উচিত।
সংক্রামক রোগের নারায়ণগঞ্জে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানায়, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, ফলে পরিবারের এক জন আক্রান্ত হলে অন্যরাও সহজে সংক্রমিত হচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীও মিলছে। টাইফয়েড ও ভাইরাল সংক্রমণের পাশাপাশি সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাল হেপাটাইটিসও দেখা যাচ্ছে। বয়স্ক, সিওপিপি ও অনাক্রমতায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার মারাত্মক সংক্রমণও ধরা পড়ছে। তবে চিকিৎসকেরা কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন যে, কোনো ক্ষেত্রেই নিজের ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না। জ্বর-সর্দি-কাশির উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ শুরু করা জরুরি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেডিকেল অফিসার নাফিয়া ইসলাম সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। সর্দি-কাশি বা জ্বরের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিজেদের ইচ্ছামতো ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।”
তিনি আরও পরামর্শ দিয়েছেন, এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ বা সেদ্ধ পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা শরীর থেকে টক্সিন বের করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে; খাওয়ার আগে বা মুখ স্পর্শ করার আগে ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া আবশ্যক। থাকার ও শোয়ার জায়গা পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখতে হবে, কারণ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর জন্য সহায়ক।
এছাড়াও, এই সময়ে রাস্তার পাশের খোলা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং তাজা রান্না করা গরম খাবার বেছে নিতে হবে। ফল ও শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে এবং সঠিকভাবে রান্না করে খাওয়ার গুরুত্বও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে মশার উপদ্রব বাড়ে বলে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ থেকে বাঁচতে মশা তাড়ানোর ওষুধ ব্যবহার, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার এবং মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে লম্বা-হাতা পোশাক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। খাদ্যতালিকায় সাইট্রাস ফল, সবুজ শাক, দই ও বাদাম জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে দ্রুত শুকনো কাপড় পরিধান করতে হবে এবং সর্বদা একটি ছাতা বা রেইনকোট বহন করা উচিত। আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে আপডেট থেকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে বর্ষাকালে নিরাপদ থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করেছেন, জমে থাকা পানি এবং এর পাশ দিয়ে হাঁটা এড়িয়ে চলতে হবে। বাড়ির আশেপাশে যেন পানি না জমে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অসুস্থ হলে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য একজন যোগ্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে। যত লোভনীয়ই হোক না কেন, বর্ষাকালে রাস্তার খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ খোলা জায়গায় প্রস্তুত করা খাবারের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা কঠিন। জ্বর, কাশি, শরীরে ব্যথা বা অন্য কোনো অস্বস্তির মতো উপসর্গ অনুভব করলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা অবস্থার অবনতি থেকে রক্ষা করতে পারে। বর্ষা মৌসুমে জনাকীর্ণ স্থানে ছোঁয়াচে রোগ দ্রুত ছড়াতে পারে, তাই জনসমাগম ও জনসমাবেশে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়াতে চেষ্টা করা উচিত। জলবাহিত সংক্রমণ রোধ করতে, বৃষ্টির সময় কানে বা চোখে জল প্রবেশ করা এড়িয়ে চলতে এবং নোংরা হাতে চোখ ঘষা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্যাঁতসেঁতে কাপড় ও জুতা ছত্রাক সংক্রমণ ও ত্বকের সমস্যার কারণ হতে পারে, তাই জামাকাপড় সঠিকভাবে শুকিয়ে এবং পা শুষ্ক রাখে এমন পাদুকা পরার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরিশেষে, তোয়ালে, রুমাল বা পাত্রের মতো ব্যক্তিগত জিনিস ভাগ করা এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে যদি পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়, কারণ এই ধরনের আইটেম সংক্রমণ সহজতর করতে পারে।