নাগরিক সেবায় ভোগান্তির অভিযোগ কাউন্সিলরদের, দাবি ‘পুনর্বহাল’
# যতটা সেবা দিতে পারতাম, কর্মকর্তারা দিতে পারছে না: শকু
# সেবা পেতে হলে কাউন্সিলরদের বিকল্প নেই: ওহিদুল
# মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে: ইসরাফিল
# অপসারণ করে দেওয়াটায় প্রস্তুত ছিলাম না: বিন্নি
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: একটা সিটি কর্পোরেশনের জন্ম-মৃত্যু সনদসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা মূল দায়িত্বে থাকেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। বিগত সময় বিরম্বণা এড়াতে নগর ভবনের কার্যক্রম ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যলয়ে সম্পন্ন হয়। তবে গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে আমূল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে। অবকাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের পর অপসারন করা হয় কাউন্সিলদের। এতে নগরবাসীর কাঙ্খিত সেবায় যেমন বিলম্ব হচ্ছে তেমনি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মোট ২৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরসহ দায়িত্ব পালন করেন মোট ৩৬ জন। মেয়র ও কাউন্সিলদের অপসারণ করার পর প্রশাসকসহ সিটি কর্পোরেশনের ১৪ জন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রায় দেড় মাস অতিক্রম হওয়ার পর অপসারণকৃত কাউন্সিলররা অভিযোগ তুলেছে ‘নাগরিক সেবা নিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসী’। অন্যদিকে নাগরিক সেবা দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা এমটাই দাবি সাবেক জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে, সিটি কর্পোরেশনের শুধু জন্ম-মৃত্যু সনদে স্বাক্ষর নয়, ওয়ার্ডের সড়ক মেরামত ও ময়লা পরিষ্কারসহ বিভিন্ন ভোগান্তির অভিযোগ তুলেছেন তারা। তাই দল মত নির্বিশেষে জনগনের সেবায় কাজ করতে নিজেদের পদে পূর্নবহালের দাবি জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলররা।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শওকত হাসেম বলেন, নাগরিকরা তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটা ওয়ার্ডে তো জন্ম মৃত্যু বা সনদের স্বাক্ষর করা পর্যন্ত কাজ থাকে না, আরও কিছু রাস্তার সংস্কার মেরামত এবং ময়লা পরিষ্কার হওয়ার বিভিন্ন কাজ থাকে। সেগুলো এখন কিন্তু হচ্ছে না। আগের গতিতে যতটা সেবা দিতে পারতাম সেই সেবাটা কর্মকর্তারা দিতে পারছে না। এখন অনেক সেবাই অনলাইনে করতে হচ্ছে। অনলাইন সেবা পেতেও একটু সময় বেশি লাগছে। দেখা যাচ্ছে ছোট একটা জিনিসের জন্য যেখানে আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে আসলেও হতো সেটার জন্য এখন নগর ভবনে যেতে আসতে হবে। তাও একবার গেলেই যে সেই সেবা পাওয়া যাবে এমনটাও নিশ্চিত নয়।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন এক নয়। এখানে সকল কাউন্সিলররা ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলর। তাই দল মত নির্বিশেষে সকলের পূর্ণ বহন করা হোক তবে যারা যারা অনুপস্থিত আছেন তাদের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলারা বা যে কাউন্সিলর আছেন তারা সম্মিলিতভাবে দায়িত্বটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন কর্মকর্তাদের কাছে দায়িত্বটা যায় তারা অনেক ক্ষেত্রেই সেবাটা দিতে পারছেন না। তাছাড়া সামনে আগামীতে জানুয়ারে ফেব্রুয়ারি দিকে স্কুলে ভর্তিসহ বিভিন্ন কাজ আসবে, তখন চাপটা বেশির বাড়ে। তখন আসলে নাগরিকের ভোগান্তিতে আরো ভয়াবহ পর্যায়ে যাবে। তাই ওয়ার্ডের নাগরিকদের সেবার স্বার্থে আমরা চাই সকল কাউন্সিলরদের পূর্ণবহাল করা হোক।
১১নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ওহিদুল ইসলাম বলেন, নাগরিক সেবা পেতে হলে কাউন্সিলরদের ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে কাউন্সিলরের পূর্ণবহন করার দাবি আমারও। তবে অনেক কাউন্সিলর এখন উপস্থিত নেই তাই যারা তারা জনসেবা দিতে ইচ্ছুক তাদেরকে সেবা দিতে দেওয়ার সুযোগ দেয়া হোক। আমার ওয়ার্ডে আমি দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও আমি এবং আমার সচিব মিলে কাজগুলো গুছিয়ে দায়িত্বগত কর্মকর্তার কাছে যাচ্ছি, সেখান থেকেই কাজগুলো করে নিতে পারছি। আমার ওয়ার্ডে কার্যক্রম সচল আছে। কিন্তু যে কাজ আমি একদিনে পারতাম সেই কাজটা করতে তিন দিন সময় লাগছে। যেভাবে আমি আমার জনগণদের দায়িত্ব না থাকার পরও সেবা দিচ্ছে, সব ওয়ার্ড এর ক্ষেত্রে চিত্রটা এরকম নয়। কাউন্সিলরদের না থাকার কারণে অনেক জনসাধারণের ভোগান্তিতে পড়ছেন। জনগণের ভোগান্তি কমাতে আমরা চাই কাউন্সিলরদের পূর্ণ বহাল করা হোক।
৯নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ইসরাফিল প্রধান বলেন, একটি ওয়ার্ডের দৈনিন্দ কিছু কাজ থাকে সেগুলো কাউন্সিলরদের পালন করতে হয়। এটা এখন সেই দায়িত্ব গুলো পালন করার মতো তো কেউ নেই। তাছাড়া অনেক জণগন জানেও না যে কোন কর্মকর্তাকে কোন কাউন্সিলরের পরিবর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেবা পেতে নগর ভবনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। কেউ এক তারিখ আসতে বলছে কেউ পাঁচ তারিখ আসতে বলছে। কোন ওয়ার্ডের জন্য কাকে দায়িত্বে দিয়েছে অনেকে জানেন না, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষেরাই সেবা থেকে অনেক বঞ্চিত হচ্ছে।
১৩, ১৪, ১৫ ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর শারমিন হাবিব বিন্নি বলেন, সরকার যেটা ভালো বুঝেছে সেটাই করছে। তারা দেশ পরিচালনা করছে দেশের স্বার্থ তারা ভালো বুজবে। কিন্তু হঠাৎ করে অপসারণ করে দেওয়াটায় আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এখনো অনেক মানুষের বিভিন্ন সনদ বা কাগজপত্রের জন্য আমাদের কাছে আসেন। আমাদের বলে দিতে হয় নগর ভবনে যেতে কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে সেখান থেকে সেবা নিতে। অনেকে আবার অভিযোগ ও করেছেন তারা সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না। আমরা কাউন্সিলররা তো একটা ওয়ার্ডের মানুষদের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, দল মত নির্বিশেষে তারা যে কোন দরকারে আমাদের কাছেই আসেন।
১০, ১১, ১২ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলার মিনোয়ারা বেগম, জনগণের যে নাগরিক সনদ সেটাও আমরা ঘর থেকে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন এমন ছোট সেবাগুলো পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল হয়ে গেছে। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর যতটা সহজে তার ওয়ার্ডের জনগণ যে সেবা দিতে পারতো ততটা সহজে একজন কর্মকর্তা পারবে না। আর আমরা তো পালিয়ে যাইনি আমরা তো আমাদের জনগণের কল্যাণের জন্য আমাদের ওয়ার্ডেই অবস্থান করছি। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে, আমাদের কাউন্সিলর এর দায়িত্বে পূর্ণ বহাল করা হোক। অনেকে হয়তো উপস্থিত নেই, তো সকলের বিষয়ে তদন্ত করে যারা ভালো তাদেরকেই তাদের দায়িত্বপূর্ণ বহন করা হোক।
১, ২, ৩ ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর মাকসুদা মোজাফফর বলেন, একটা মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যত ধরনের সার্টিফিকেট বা সনদ দরকার, কম বেশি সবগুলোতে কাউন্সিলর এর স্বাক্ষর লাগে। সিটি কর্পোরেশনের গঠন করার সময় ২০১১ সাল থেকে আমি কাউন্সিলর এর দায়িত্বে ছিলাম। প্রথম থেকেই জনগণের সেবা আমি সর্বদা থেকেছি। কিন্তু কাউন্সিলর পরিবর্তে এখন যে কর্মকর্তারা দায়িত্ব নিয়েছেন তারা সেবা দিতে পারছেন না। পরিচয়পত্রের জন্য বা প্রত্যয়নপত্রের ফরমের জন্য সাধারণত ১০ টাকা একটা ফি লাগে। আমরা অনেক কাউন্সিলররাই সেই ফি টা নেই না। কিন্তু এখন যে অফিসাররা দায়িত্বে আছেন তাদের কাছ থেকে এ ধরনের সনদ নিতে জনসাধারণের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সেখানে আসা যাওয়ার খরচ তো লাগছে তাছাড়া ভোগান্তিও বেড়েছে। জায়গা সম্পত্তির ক্ষেত্রে যে ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, সেটা তারা দিতে পারছে না বা পারবে না। কারণ আমরা কাউন্সিলররা আমাদের এলাকাবাসীর জনগণকে শুরু থেকে চিনি। কে কেমন, কে কার পুত্র সকলের সম্বন্ধে আমার ধারণা আছে। কিন্তু একজন কর্মকর্তা সে তো হুট করেই কে কার সন্তান, কে কার ওয়ারিশ সেটা শনাক্ত করতে পারবে না। এছাড়াও আমার ওয়ার্ডের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার সংস্কারসহ অনেক কাজগুলো বাকি। অনেক জায়গা দেখা যাচ্ছে রাস্তার লাইট জ্বলে না, সড়কে খানা-খন্দ হয়ে রয়েছে, চুরি-ডাকাতি বাড়ছে। যেটা হয়তো কাউন্সিলর থাকাকালীন সময় কমানো যেত। আমার মত সকল কাউন্সিলরদের পূর্ণবহাল করা উচিত। একজন কাউন্সিলর তার চেয়ারে বসলে আসলে কোন দলের থাকে না। এনসিসির কাউন্সিলররা তো আসলে ইলেকশনে এসেছে, সিলেকশনে করে আসে নি।
৪, ৫, ৬ ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা তো চুরির নির্বাচন করে তারপর কাউন্সিলরের পদে আসে নাই। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, কিন্তু আমার আমাকে কাউন্সিলর করার জন্য বিএনপির লোকেরাও তো ভোট দিয়েছে। তারা মনে করেছে তাদের ওয়ার্ডের জন্য আমি ভালো তাই আমাকে ভোট দিয়ে কাউন্সিলর বানিয়েছে। আমি তোমার ওয়ার্ডের সবাইবে জনগণ হিসাবেই সেবা দেই। সেখানে কে বিএনপি, কে আওয়ামী লীগ আমরা সেটা দেখি না। কাউন্সিলর এর পদে অনেক সময় ধরেই সেবা দিয়ে আসছি তাই জনগণের কি ধরনের সেবা দরকার সে বিষয় আমরা জানি। কিন্তু এখন যে কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে তাদের কাছ থেকে জনগণ সেবা পাচ্ছে না। আমার ওয়ার্ডের অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করে তারা নগর ভবনে গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে না, অনেক ধরনের সেবা কর্মকর্তারই দিতে পারছে না, দুই তিন দিন কর্মকর্তা ছুটিতে থাকে বা কোন সেবা কোন কর্মকর্তার কাছে পাওয়া যাবে সেটা নিয়েও আমাদের স্থানীয়দের হয়রানি হতে হয়। তাছাড়া আগে আমাদের কাউন্সিলর অফিস আমাদের ওয়ার্ডেই ছিল কিন্তু এখন নগরভবন যেতে হয়। সেখানে আসা-যাওয়া করতেই ২০০-৩০০ টাকা খরচ হয়ে যায় যেটা একজন গরিব মানুষ পারে না। সেজন্য আমরা চাই দল মত নির্বিশেষে কাউন্সিলরদের পূর্ণবহাল করা হোক।