চলতি মাসেই প্রকাশিত হবে ‘নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য’
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: এ মাসেই প্রকাশিত হচ্ছে ‘নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য’ গ্রন্থ। গ্রন্থে ১২ টি অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি, প্রশাসনিক নারায়ণগঞ্জ, জাতি গঠন ও সংস্কৃতির রূপান্তর, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, সংগীত, সংগঠন, সংগ্রম (ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ’৬৯, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভুত্থান ’৯০, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ’২৪), প্রত্নসম্পদ, প্রাচীন স্থাপত্য ও উল্লেখযোগ্য স্থান, ১২ শিল্প-বাণিজ্য।
একটি জনপদের ইতিহাস হচ্ছে, সে অঞ্চলের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতির ও সে অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত, অর্থাৎ সে অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতাই সে অঞ্চলের ইতিহাস। অন্যভাবে বললে, সময়ের সাথে সাথে সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, চিন্তা, রুচি, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির যে পরিবর্তন ঘটে; পরিবর্তনের সেই ধারাবাহিকতাই সে সমাজের ইতিহাস। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজে নতুন যে অর্থনৈতিক অব-কাঠামো তৈরি হয়, তা ই সংস্কৃতির বুনিয়াদ।
যদিও বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সংস্কৃতিতে এ অঞ্চলের নদী, জলবায়ু, ভূমি ও প্রকৃতির গভীর প্রভাবের কারণে এখানে এক অনবদ্য এক্যতান বিদ্যমান; তার পরেও অঞ্চল ভেদে সংস্কৃতিতে তৈরি হয়েছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র। আর তাই নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্য অঞ্চল থেকে আলাদা এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকা দখলে নিয়ে একে ‘জাহাঙ্গীর নগর’ নামকরণের মাধ্যমে রাজধানী করার পরথেকে ঢাকা শহরের সূচনা বলে মনে করা হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, কত্রাবো, খিজিরপুর বিভিন্ন অঞ্চল ঢাকা রাজধানী হওয়ার কয়েকশ বছর আগে থেকে রাজধানী হওয়ার সুবাদে নারায়ণগঞ্জ যে শহরের দিক থেকে ঢাকার চেয়েও পুরনো তা বহু ইতিহাসবিদের বর্ণনাতে উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তা কত বছর পুরোনো তা সুনিদৃষ্টভাবে এখনো নিরুপণ করা যায় নি। কিন্তু উয়ারী-বটেশ^রে প্রত্নখননের পর জানা যায়, এই জনপদ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পুরোনো।
১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজি বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে তিনি রাজ্য শাসনের সুবিধার্থে বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে সোনারগাঁকে পূর্ব বাংলার রাজধানী করেন। তাঁর শাসনামলেই সোনারগাঁ পূর্ব বাংলার রাজধানী হয়। পরে তিন শতাব্দী পর্যন্ত সোনারগাঁ বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা (কুমিল্লা), চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট (সিলেট) রাজধানী সোনারগাঁ এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। যার ফলে শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে সোনারগাঁ ছিল অন্যান্য অঞ্চল থেকে অগ্রসরমান।
কৌটিল্য (খ্রি:পূ: চতুর্থ শতক) তার অর্থ শাস্ত্রের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের একাদশ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের তৈরি দুকুল (সূক্ষ্ম বস্ত্র) শুভ্র ও মসৃন। সুতরাং বঙ্গের সংস্কৃতি খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতকেও ছিল। অর্থাৎ আড়াই হাজার বছর আগে বঙ্গের যে খ্যাতি, তা প্রধানতঃ সূক্ষ বস্ত্র (মসলিন) কে কেন্দ্র করে, আর উন্নত মসলিন তৈরির কার্পাস উৎপন্ন হতো সোনারগাঁয়ে। তুলা বা কার্পাসের জন্য শ্রেষ্ঠ অঞ্চল ছিল সোনারগাঁ অঞ্চল। ঐতিহাসিক স্বরূপ চন্দ্র রায় তাঁর সুবর্ণ গ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মহাভারতের ভীম ‘লাঙ্গল বন্দে’ এসেছিলেন।’ লাঙ্গল অষ্ট্রিক শব্দ। সুতরাং শব্দটি আর্থ-পূর্ব যুগের। আর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভারতে এসেছিলেন। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাভারতকে প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। এ সব বিষয়ে এ গ্রন্থের ‘নারায়ণগঞ্জ’ অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোকপাত করা হয়েছে।
অন্যান্য জেলায় ইতিহাস সংবলিত কমবেশি কাজ হলেও নারায়ণগঞ্জে তেমন একটা হয় নি। কিন্তু এইটি একটি জেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু প্রশ্ন থাকলেও সুধীজন পাঠাগার থেকে প্রকাশিত ‘নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থটি এখানে এখনো একমাত্র আকড় হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত আসগর এ অঞ্চলের লোক সাহিত্য নিয়ে কিছু কাজ করেছেন, যা গুরুত্ব বহন করে।
কোন ইতিহাসই কখনোই পুরো জনগোষ্ঠীর কাছে সমাদৃত হয় না। ইতিহাস থাকে বিজয়ীদের পক্ষে, পরাজিতরা তা সহজে গ্রহণ করতে পারে না। আবার এও সত্য যে, মনের মাধুরীতে ইতিহাস হয়না। এর নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্যের উপর ইতিহাসের সত্যতা নির্ভর করে। এ গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যাদির উৎস উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসে নিজের কথা বা মতামত নয় নির্মোহতাই গুরুত্বপূর্ণ। তার পরেও বলতে হয় ইতিহাস একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংগৃহিত নতুন তথ্যই কেবল পুরোনোকে খারিজ করে নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারে। আবার ইতিহাসের উপরই দাঁড়িয়েই মানুষ তার ভবিষ্যৎ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলে। ‘নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য’ গ্রন্থটি বর্তমান ও আগামীর মানুষদের শক্ত মাটির উপড় দাঁড়াতে, শিকড় বা উৎসের দিকে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।