ঘরে বসেই সেবা পেয়ে স্মার্ট হচ্ছেন আড়াইহাজারের কৃষকরা
লাইভ নারায়ণগঞ্জ: দেশে প্রথম স্মার্ট কৃষক হতে চলেছেন আড়াইহাজার উপজেলার কৃষকরা। ঘরে বসেই তারা সব রকমের সেবা পাবেন। মেঘনা নদীর ওপারের দুর্গম কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের কোন গ্রামে এক কৃষকের গরু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওই কৃষককে গরুর চিকিৎসার জন্য আড়াইহাজার সদরে আসতে হবেনা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই অনলাইনে রোগের বর্ণণা ও ছবি তুলে দিলেই উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা কৃষককে চিকিৎসা পরামর্শ দিবেন। ‘স্মার্ট কৃষক আড়াইহাজার’ অনলাইন প্লাটফর্মে কৃষকরা কৃষিপণ্য চাইলেই বিক্রি করতে পারবেন। আবার কিনতেও পারবেন। এতে প্রশাসনের নজরদারি থাকবে। কোন মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হতে পারবেনা।
আড়াইহাজারের কৃষকরা কৃষি, প্রাণী সম্পদ, মৎস্য বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারবেন। তাছাড়া স্মার্ট কৃষকদের হাট বসবে সপ্তাহে একদিন । কৃষকদের নিয়ে উঠান বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। স্মার্ট ঋণ দেয়া হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সচরারচর প্রশ্নোত্তর ও সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে। সবমিলিয়ে কৃষকরা স্মার্ট হলে পুরো উপজেলাই শতভাগ স্মার্ট হয়ে যাবে।
২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর আড়াইহাজারে ‘স্মার্ট কৃষক আড়াইহাজার’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের টিম লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। সার্বিক তত্ত্বাবধান করবেন আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ইশতিয়াক আহমেদ, বাস্তবায়ন করবেন উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা: সজল কুমার দাস, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান ফারুকী ও উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জেসমীন আক্তার।
জানাগেছে, স্মার্ট কৃষক প্লাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে আড়াইহাজারের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিজিটাল স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরী হবে। চলতি বছরের শুরুতে ওয়েবসাইটটি তৈরী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪ হাজার জন রেজিস্ট্রেশন করে অনলাইন সুবিধা গ্রহণ করেছেন। স্মার্ট ভ্যাকসিনেটর তৈরীর জন্য প্রতি পৌরসভা ও ইউনিয়ন হতে ৩ জন করে মোট ৩৬ জনকে প্রশিক্ষণ, টিকাসামগ্রী ও টিকাবক্স দেওয়া হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাকি কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। বর্তমানে পরীক্ষা মূলক ভাবে চলছে। আগামী ২ মাসের মধ্যে পুরোপুরি চালু করা হবে।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা: সজল কুমার দাস বলেন, স্মার্ট কৃষকের মাধ্যমে অনলাইনে প্রেসক্রিপশন করা যাবে। দূরবর্তী স্থান হতে পশু না এনে অনলাইনে ছবি টেক্সটও অন্যান্য তথ্য প্রেরণ করে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবে। প্রতিটি ইউনিয়নে ৩ জন ভ্যাক্সিনেটর থাকবে। যারা খামারীর চাহিদা অনুযায়ী গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীদের চিকিৎসা প্রদান করবে। টিকা, ঔষধ, পশু খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের মজুদ ও প্রাপ্যতা এবং দাম উল্লেখ থাকবে। কৃত্রিম প্রজনন ৩ মাস চাষ সম্পর্কিত তথ্য ও সেবা দেয়া হবে। পশু পাখিকে টিকা প্রদানের অগ্রিম এসএমএস মোবাইলে প্রেরণ করা হবে। হট লাইন নাম্বার থাকবে। নিয়মিত ই হাউজ অনলাইন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা থাকবে। অনলাইন উঠান বৈঠক করা হবে। সকল পণ্য বিক্রয়ের জন্য ডিজিটাল মার্কেট এবং অনলাইন পেমেন্ট এর ব্যবস্থা থাকবে। আধুনিক জবাই খানা পরিচালনা করা হবে। নিয়মিত ভেটরিনারিয়ানের ছাড়পত্র নিয়ে পশু জবাই করতে হবে।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জেসমীন আক্তার বলেন, মৎস্য সম্পদে আড়াইহাজার একটি সমৃদ্ধ উপজেলা। স্মার্ট কৃষক আড়াইহাজার নামক এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সকল মৎস্যচাষী ও জেলেদের সরকারী সেবার আওতায় আনা হবে। মৎস্য চাষীদের আধুনিক লাভজনক প্রযুক্তি সম্পর্কিত পরামর্শ ও চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনিং প্রদান করা হবে , এক্ষেত্রে চাষীকে অফিসে আসতে হবে না। রোগবালাই সংক্রান্ত পরামর্শ ও চাষীরা পেয়ে যাবেন শুধুমাত্র একটি ছবি পোষ্টের মাধ্যমে। মৌসুম ভেদে ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে মাছচাষে প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে আগাম বার্তা দেয়া হবে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং ও চাহিদা ভিত্তিতে উঠান বৈঠক করা হবে। এছাড়াও মাছ চাষ যান্ত্রিকরন এবং আইওটি বেইসড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিক ফলন, মিনি ফিস প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে মাছের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ এবং মাছচাষী ও জেলেদের মাছের যোগ্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে ইকমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। যেখানে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য থাকবে না। এছাড়াও মাছচাষীদের সহজেই কৃষিঋণ প্রাপ্তির সুব্যবস্থা থাকবে উদ্ভাবনী এই প্রকল্পে।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইশতিয়াক আহমেদ জানান, স্মার্ট কৃষক আড়াইহাজার আগামীদিনের কৃষক তৈরী করার জন্য উপজেলা প্রশাসন আড়াইহাজারের একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ। আড়াইহাজারের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীকে এই স্মার্ট প্লাটফর্মের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয়ে শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্রে নয় তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও পরিবর্তন আসবে।
আড়াইহাজার উপজেলা কৃষি অফিসার মাহমুদুল হাসান ফারুকী বলেন, আড়াইহাজার উপজেলার ৪ হাজার কৃষি পরিবারকে আমরা ইতিমধ্যেই এই ডিজিটাল প্লাটফর্মে যুক্ত করতে পেরেছি এবং আগামী ২ মাসের মধ্যে সকল কৃষককে এর আওতায় আনতে পারবো। পরবর্তীতে আমরা একই সাথে সকল কৃষককে তাদের কৃষি, মৎস্য বা প্রানিসম্পদ সংক্রান্ত যে কোন সমস্যার সমাধান দিতে পারবো যেটা অন্যকোন উপায়ে সম্ভব নয়। আমাদের কৃষককে আমরা স্মার্ট করতে চাই তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহযোগীতার মাধ্যমে যেমন তাদের বীজ বপনের আদর্শ সময়, রোগের আগাম বার্তা, হাঁস মুরগীর ভ্যাকসিন সিডিউল ইত্যাদি তথ্য প্রতিনিয়ত কৃষকদের ভয়েস এসএমএস এর মাধ্যমে তার মোবাইল ফোনে প্রেরণ করে।
এছাড়াও, প্রতি বছরই কৃষকদের জন্য বরাদ্দ শস্য ঋনের প্রনোদনা অংশ বিতরণ করা যায় না তার অন্যতম কারন শস্য উৎপাদনের সময় থাকে খুব কম এই কম সময়ের মধ্যে ব্যাংকের সকল ফরমালিটি শেষ করে লোন পাওয়াটা কঠিন। আমাদের প্লাটফর্মে সকল ব্যাংকগুলো যুক্ত আছে এবং এর মাধ্যমে কৃষকদের লোনের ব্যবস্থা অতিদ্রুত এবং সহজে দিতে পারবো। আমরা বিশ্বাস করি আগামির যে কৃষি যুগে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি তার ছোট একটা পদক্ষেপ হবে আমাদের এই প্রয়াস।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, স্মার্ট কৃষক উদ্যোগটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। উদ্যোগটিতে সার. বীজ থেকে শুরু করে সব কিছু বিতরণ ও বিক্রি স্মার্টলি করা হবে। কৃষকদের ডাটাবেজ থাকবে। কি কি চাষ করবে তার ম্যাসেজ করলে কৃষক তার সমাধান অটো পেয়ে যাবে। অথবা ফোন কল সেন্টারে চলে যাবে। পশুপালন, হাসঁ-মুরগী এর রোগ বালাই নিয়ে আপডেট করে সাজেশন দেওয়া হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, মার্কেটের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন, বিপণন স্মার্টলি করা হবে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ২০৪১ সালে যে স্বপ্ন দেখছেন তা বাস্তবায়নে কাজ করবে আমাদের স্মার্ট কৃষকরা।