কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু ও শামীম ওসমান এর চাচা “মুস্তফা সারোয়ার”
সুজিত সরকার: ছাত্র রাজনীতি করার সময়ে ” মার্কসবাদী দৃষ্টিতে নজরুল” বইটি ১০ ( দশ ) টাকা মূল্যে বিক্রি করেছি সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদরের কাছে –
১৯৯৯ সালে ঢাকায় নজরুল জন্মশতবার্ষিকী পালনের দিনে আমি ও আমার বন্ধু মহিউদ্দিন আহমেদ মাসুদ ( বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ) ঢাকায় যাই নজরুল সম্পর্কে বিশদ আলোচনা শুনতে। সেদিন যা আজ পর্যন্ত যা জানতে পারি নাই তা স্নেহের ছোটভাই ” রাজু আহমদ ”
নারায়ণগঞ্জের আলো’র সম্পাদক ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ও ডিবিসি টিভি চ্যাণেল এর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি তিনি ফেইসবুকে লিখেন-
আমাগো দেশে কিছু শি-ক্ষিত শ্রেনীর একটা কমন কনসেপ্ট আছে। রবীন্দ্র চর্চা করলে বা রাবিন্দ্রিক ভাব-সাব নিলে সুশীল সুশীল একটা ভাব চইল্লা আহে। তাই বেশীর ভাগ তথাকথিত সুশীলরাই রবীন্দ্র নাথ নিয়া আলোচনা করতে ভালোবাসে। তারা নজরুল কে নিয়া খুব একটা কথা কয় না। এর অবশ্য ২ডা কারণও আছে। নজরুল বুজতে গেলে তাগো দাত ভাইঙ্গা যায় আর নজরুল তো জমিদার বাড়ীর পোলা আছিলো না।
গতকাল ছিল বাংলা সাহিত্যের ধূমকেতু’র জন্মদিন। এখনও অবধি আমার ফ্রেন্ড লিস্টের কারো পোস্ট চোখে পরলো না।
““““ফারাকে জানা মে হামনে সাকি..
লাহু পিয়া হে সারাব কারকে,
তাপ-এ আলামনে জিগার কো ভুনা
ইও হামনে খায়া কারায় কারকে ।
—————-বিদ্রোহী নজরুল
রাজু আহমেদ এর লেখাটি পড়ে উৎসাহিত হয়ে চেষ্টা করলাম –
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই অকস্মাৎ বাকরুদ্ধ হন। তারপর বেড়ে চলে কবির জিহ্বার আড়ষ্টতা। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে চেঁচাতেন। কখনো বিমর্ষ, দীপ্তিহীন ও নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন মহাবিদ্রোহী। দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যিনি অকুতোভয় হয়ে বলেছেন, লিখেছেন, গর্জে উঠেছেন, জেলও খেটেছেন; ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র কয়েক বছর আগে লেখনি অস্ত্রের সেই ঝনঝনানি যেন থেমে যায় হঠাৎ করেই। কলকাতায় কবিকে চিকিৎসার কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে, ক্রমেই কবির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
তারপর পেরিয়ে যায় অনেক বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নজরুলকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেন বাংলা মায়ের আরেক মহাবিদ্রোহী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ১৩৮০ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। সরকারিভাবে নজরুলকে আনতে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেদিন বিকেলেই নজরুলকে দেশে আনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন মন্ত্রী মতিউর রহমান ( রংপুর ) এবং আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের শামীম ওসমান এর চাচা “মুস্তাফা সারোয়ার”কে ভারতে পাঠানো হয়। সঙ্গে দিয়ে দেন সরকারি অফিসিয়াল পত্র।
নজরুলকে ‘হে কবি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখে দিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। চিঠিতে নজরুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। চিঠি লিখে দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদেরকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আশা করি কবিকে ছাড়া খালি হাতে আসবে না’।
বিদ্রোহী কবি নজরুল সরকারিভাবে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে—খবর প্রচারিত হতে থাকে রেডিও এবং টেলিভিশনে। এতে কলকাতায়ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
ভারতের দমদম বিমানবন্দর থেকে কলকাতা প্রবেশ করতে হয় যে সড়ক দিয়ে, তার নাম ‘কবি নজরুল ইসলাম এভিনিউ’। এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি মন্ত্রী মতিউর রহমান এবং মুস্তাফা সারোয়ার। রাস্তার দুপাশে কিছু পোস্টার দেখতে পান তারা। তাতে লেখা ‘অসুস্থ কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না’। কলকাতার কয়েকটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই পোস্টার লাগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, কবি অসুস্থ তাই তাকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না— সংগঠনের কর্তারা এমন ডাক্তারি সার্টিফিকেটও যোগাড় করে রাখে। নজরুলকে বাংলাদেশে আনার বিপক্ষে চালাতে থাকে প্রচার-প্রচারণা। এমনকি বিক্ষোভও করা হয়।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থ রায়ের বৈঠক হয়। সেখানকার ‘রাইটার্স ভবনে’ অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ভারতীয়দের প্রতিবাদের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাকে সেদিন খুব চিন্তিত দেখায়।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলও চিন্তায় পড়ে যান। যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর সে সময়ের রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যতম সচিব প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী জানান যে, কবি নজরুলকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে না পারলে, বাংলাদেশেও বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। কারণ, ইতোমধ্যেই রেডিও এবং সংবাদপত্রে প্রচার করা হয়ে গেছে যে, অমুক সময় কবিকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় অবতরণ করবে। এ খবর পেয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উভয় সঙ্কটের পড়েন।
কলকাতায় বিক্ষোভ, অপরদিকে ঢাকায় প্রতিবাদের সম্ভাবনা—এই উভয় সঙ্কটের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সুসম্পর্ক। এ সম্পর্কের ফলেই নজরুলকে বাংলাদেশে দিতে রাজি হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আবারও বৈঠক হয় ‘রাইটার্স ভবনে’। তবে শর্ত থাকে যে, কবির অসুস্থতার ব্যাপারে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গ্রহণ এবং একটা সময় পরে কবিকে ভারতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয় বৈঠকের পরদিন ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভোরেই কবিকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ বিমান। খুব ভোরেই কবিকে বিমানে ওঠানো হয়। এতে অন্যান্যদের মধ্যে সহযোগিতা করেন কবির দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। বিমানবন্দরে দ্রুত ছুটে আসে কলকাতার ফটো সাংবাদিকরা, কিন্তু পাননি। কারণ ততক্ষণে কবিকে বহনকারী বিমানটি আকাশে উড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের পাশাপাশি পরে কলকাতায় বোমা বিস্ফোরণের খবরও পাওয়া যায়।
৩০ মিনিটের মধ্যেই বিমানটি উড়ে আসে ঢাকায়। কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে ততক্ষণে লোকে-লোকারণ্য পুরো বিমানবন্দর এলাকা। এত মানুষ সেখানে ভীড় জমায় যে, বিমানের সিঁড়ি লাগানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। খুব গরম পড়েছিল সেদিন। বিমানে অপেক্ষামান কবি এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানেই শুরু হয় কবিকে সেবা-শুশ্রূষা। এদিকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না অপেক্ষামান হাজার হাজার জনতাকে। বিমানের দরজা খুলে জনতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে অনুরোধ করা হয়। তবুও নজরুল-পাগল বাঙালিকে শান্ত করা যাচ্ছিল না।
অবস্থা বেগতিক দেখে গোপনে কবিকে নামানো হয় বিমানের পিছনের দরজা দিয়ে। কবিকে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়। বিমানবন্দরের উত্তর দিকের ফ্লাইং ক্লাবের পথ দিয়ে কবিকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
মহান দুই বাঙালির সাক্ষাৎ:
কবিকে আনার আগেই বঙ্গবন্ধু কবি পরিবারের জন্য ধানমন্ডিতে ‘কবি ভবন’ নামে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে রাখেন। কবিকে কবি ভবনে আনার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দ্রুত ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাতে ফুলের ডালি। এ সময় ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। কবি বঙ্গবন্ধুর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কথা বলতে না পারলেও মুখ নাড়ছিলেন কবি। ক্যামেরাবন্দী করা হয় বিখ্যাত সেই মুহূর্ত। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই দৃশ্য দেখে অবাক হন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিশ্বসেরা রাজনীতির কবি রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতো দুই মহাবিদ্রোহীর মিলন মেলা! একজন বিদ্রোহী রণক্লান্ত এবং বাকশক্তিহীন, আরেকজন বিদ্রোহী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। বিছানায় শুয়ে থাকা থেমে যাওয়া আগ্নেয়গিরির সামনে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির দাঁড়ানো।
এক এক করে কবিকে স্বাগত জানাতে আসতে থাকেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। হাজার হাজার মানুষ ফুল হাতে ভীড় জমায় কবি ভবনের আশাপাশে।
এরমধ্যেই কবি পরিবারকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। কবি পরিবার খুশি হন। কবির স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নতির দিকে যেতে থাকে। কয়েকদিন পর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কবিকে দেখতে আসেন। এক সাংবাদিক সম্মেলনে কবিকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রাখার দাবি জানান তিনি।
প্রশ্ন দাঁড়ায়, ভারত সরকার তাতে রাজি হবে কি না। কবিকে ঢাকায় আনতে গিয়েই তো কত বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এখানেও ত্রাণকর্তা হয়ে উপস্থিত হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সুসম্পর্ক। একে অপরে ছিলেন ভাই-বোনের মতই। ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো বাংলাদেশেরই বোন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সারা বিশ্ব সফর করেছেন। কোটি কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা গান্ধী সুসম্পর্কের জোরেই নজরুলকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় রাখার পথ সুগম হয় এবং রাখা হয়।
তথ্যসূত্র:
১। মো. এরশাদ হোসেন সম্পাদিত, বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
২। মুস্তফা সারওয়ার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কাছে থেকে দেখা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৭।
৩। ড. সৌমিত্র শেখর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, অগ্নি পাবলিকেশন্স, ঢাকা, নতুন সংস্করণ জানুয়ারি ২০১২।
৪। দৈনিক বাংলার বাণী, ২৬ মে ১৯৭৩।
৫। দৈনিক যায়যায় দিন, ২৯ আগস্ট ২০১৪।
৬। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন ।
৭। নজরুলকে ঢাকায় আনার ইতিহাস
বাশার খান
লেখক:- রাজনৈতিক কর্মী