সোমবার, জুলাই ২১, ২০২৫
মতামত

আমার বাবা ডা. শাহাদাৎ হোসেন

রফিউর রাব্বি: আমার বাবা ডা. শাহাদাৎ হোসেন (২৭ জানুয়ারি ১৯২২—২১ জুলাই ১৯৯৪) ভাষা—সংগ্রমী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, রাজনীতি করতেন। শুরুতে মুসলিম লীগ, পরে মুসলিম আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। পেশায় ছিলেন দন্ত—চিতিৎসক। কলকাতা থেকে পড়াশুনা করেছেন। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৪৮ সিরাজদৌল্লা রোডে ডাক্তারখানা খুলে বসেন। তিনি ছিলেন তখন শহরে প্রথম ও একমাত্র দন্ত চিকিৎসক। আত্মিয় ও মহল্লার পরিচিত জনদের চিকিৎসা দিয়ে কখনো টাকা নিতেন না। আমার দাদা ও দাদীর জন্মস্থান যেহেতু এ শহরে সেহেতু আত্মিয়—স্বজননে কমতি ছিল না। শহরের প্রতিটি এলাকাতেই আত্মিয়—স্বজন। যাদের অষুধ কেনার টাকা ছিল না, তাদের পাশের ফার্মেসী থেকে অষুধ কিনে দিতেন। উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন না, কোন লোভ ছিল না, গেঁাড়ামী ছিলনা। খুবই উদার ছিলেন, মানুষকে ভালোবাসতেন। শৈশবে দেখেছি ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছেন। আমাদের বাসাটা তেমন বড় ছিল না। রাতে আমরা তখন গাদাগাদি করে মেঝেতে ঘুমাতাম।

১৯৭১ সালে বাবা নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে টাকা দিতেন। দলের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় দলের মানুষদের টাকা দিতেন। আমার মা ব্যপারটি ভালো ভাবে দেখতেন না। আমরা অসচ্ছল না হলেও ধনী ছিলাম না। আমরা পাঁচ ভাই—বোন এবং খালুর অকাল মৃত্যু হলে খালার এক মাত্র মেয়েকে আমাদের সংসারে নিয়ে আসা হয়। মামা আমাদের বাসায় থেকে কাজ শিখতেন। বাবার ডাক্তারখানার সহযোগী আব্দুল্লা আমাদের বাসায়ই খাওয়াদাওয়া ও বাজার—সদাই করতেন। আমাদের গৃহশিক্ষকও আমাদের বাসায়ই খেতেন। উপরন্তু প্রতিদিন দু’একজন আত্মিয়—স্বজন থাকতোই। আমাদের সংসারটি খুব ছোট ছিল না। তবে বাবার এ ব্যাপাটিকে আমি সমর্থন করতাম। আমার ভালো লাগতো। বাবার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক না থাকলেও আমাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া ছিল। একে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। বাবা আওয়ামী লীগ করলেও আমাকে প্রথম ছাত্র ইউনিয়ন ও পরে কমিউনিস্ট পার্টি করতে কখনো বাঁধা দেন নি। নানাজন নানা কথা বললেও তিনি তাতে গা করেন নি। পরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আমরা একসাথেই করেছি। সাতাশিতে তিন জোটোর সমন্বয়ে ২২দল গঠিত হলে ২২দলের সভা— সমাবেশ ও গোপন বৈঠকে বাবা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আর আমি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত থেকেছি। সে সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে আরও থাকতেন সুলতান মাহমুদ মল্লিক ও শেখ মিজানুর রহমান। তখন নারায়ণগঞ্জে ২২দলের অনেক নেতাই কারা—অন্তরীণ হয়েছিলেন। প্রকাশ্যে সভা করার সুযোগ ছিলনা তখন। গোপনে করতে হতো। কিন্ত এক সময় আমরা দেখলাম আমাদের কয়েকটি সভার সংবাদ আগেই পুলিশ জেনে যাচ্ছে। আমরা যাওয়ার আগেই সেখানে পুলিশ গিয়ে হাজির। আমাদের মধ্য থেকেই দু’এক জন তা পুলিশকে জানিয়ে দিত। পরে ঠিক হলো সভার জায়গা আগে কাউকে জানানো হবে না। জায়গার আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জনকে হাজির হতে বলে, সেখান থেকে সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে সভার জায়গাটি একক ভাবে আমি একাই ঠিক করে অন্যদের যথা সময়ে জানিয়ে দিতাম। সাতাশির আন্দোলনের কিছুদিন আগে আমি কিউবা থেকে এসেছি।

১০ নভেম্বর থেকে প্রতিদিনই হরতাল ও কারফিউ। ১৬ নভেম্বর সকালে পঞ্চবটি থেকে শ্রমিকদের একটি মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করছিলাম। আগে ধারণা করা হয়েছিল শ্রমিক জমায়েত হবে হয়তোবা পাঁচ’শ থেকে হাজার। কিন্তু জমায়েত হয়েযায় ৬/৭ হাজার। আমাদের মিছিলটি শহরে ঢুকে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখছিলাম ঐ অফিসের সামনে জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান দাঁড়িয়ে; সাথে কাটা রাইফেল তাক করে গোলাম সারোয়ার (পরবর্তীতে যুবলীগ) সহ অনেকে। মিছিলটি জাতীয় পার্টির অফিস অতিক্রম করে চলেযাওয়ার পর জাতীয় পার্টির কর্মীরা মিছিলের পেছন থেকে গুলি করে। আমাদের ৬৪ জন শ্রমিক ও কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। নারায়ণগঞ্জের এ সংবাদটি ঐ দিন বিবিসি ও ভয়েস আব আমেরিকা গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছিল। বিটিভি বা রেডিওতে তখন বিরোধীদের কোন সংবাদ প্রচার হতো না। তখন আমাদের সঠিক সংবাদ জানার মাধ্যমই ছিল বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা। বিটিভিকে বলা হতো ‘সাহেব—বিবি—গোলামের বাক্স’। পরদিন ১৭ নভেম্বর জাতীয় সংবাদ পত্রে ‘সম্প্রতি কিউবা ফেরৎ ২২দলীয় নেতার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা’ শিরোনামে নাসিম ওসমানের একটি বিবৃতি প্রকশিত হয়েছিল। সে সংবাদের পাশেই ছাপা হয়েছিল কাটা—রাইফেল হাতে গোলাম সারোয়ারের মিছিলে গুলি করার ছবি। তবে ঐ দিন ২২দলের কোন কর্মী জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা না করলেও এর পরদিন পরদিন ১৭ নভেম্বর বিকেলে দুই—নং রেলগেট চত্বরে ২২দলের সমাবেশ শেষে একটি বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ কালে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলের উত্তেজিত জনতা জাতীয় পার্টি অফিসে হামলা করে, আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ অফিসের সমস্ত আসবাব পত্র রাস্তায় এনে ভস্মীভূত করে। নাসিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বাবাকে নিয়ে আমার কোন লেখা নেই। আছে বিক্ষিপ্ত কিছু কিছু স্মৃতি, অনুভুতি, ভালোলাগা। মাঝে মাঝে ভাবতাম এমন মানুষটি এ দলটি করেন কেন? একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি এ দল কেন করেন, যে খানে ……এর মতো লোকজন আছে? উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমরা পার্টি করি শেখ সাহেবের জন্য।’ শেখ মুজিবকে তিনি সব সময় ‘শেখ সাহেব’ বলতেন। তাঁর প্রতি ছিল বাবার প্রচণ্ড ভালোবাসা। আমাদের সে সময়ে বাবাকে স্মরণ করার জন্য আলাদা কোন দিন ছিল না। আমাদের বিয়ের দিনটি ঠিক করা হয়েছিল ১৯৯৪ সালের ৫ আগস্ট। এর কয়েকদিন আগে ২০ জুলাই রাতে আমার ছোট বোন শিলাকে বিয়ের শাড়ি কেনার টাকা দিয়ে কলকাতায় তাঁর এক বন্ধুরকে চিঠি লিখলেন বাবা। শিলা পরদিন কলকাতা যাবে। এরই কিছুক্ষণ পর রাত একটায় বাবা চলে গেলেন। বাসা থেকে বের করতে করতেই চির বিদায়। কোন অসুখ নেই, রোগ নেই, বিছানায় পড়া নেই। কাউকে কোন রকম কষ্টও দিলেন না। অবিশ্বাস্য এক যাত্রা; যা চিরন্তন ও অনিবার্য। বাবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা।

লেখক: রফিউর রাব্বি, আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ

RSS
Follow by Email