সোমবার, নভেম্বর ১১, ২০২৪
Led01Led05বিশেষ প্রতিবেদন

নগরীতে জনসংখ্যার বিপরীতে নেই স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট, বিব্রত হচ্ছে বৃদ্ধ-নারীরা

# ভেতরে যাওয়ার পর খুব ইনসিকিউর ছিলাম: ভুক্তভোগী নারী
# মাস্কের ভেতর দিয়ে গন্ধ নাকে লেগে যায়: ভুক্তভোগী পুরুষ
# ১৪টি পাবলিক টয়লেট আছে, বৃদ্ধি করা উচিৎ: এনসিসি সিইও

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: ব্যস্ত নগরীর নারায়ণগঞ্জে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। যানজট থেকে শুরু করে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নিত্যদিনের দৃশ্যমান মুসিবত হয়ে উঠেছে নগরবাসীর। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে অর্ন্তবর্তী কালীন সরকার কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, জনজীবনে প্রতিনিয়ত জনদুর্ভোগ সংস্কার করার প্রতিকার মিলছে না কোনভাবেই। স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের পট পরিবর্তন হওয়ায়, প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে দ্বায়িত্ব পালনে। তবে তাদের দাবি ‘খুব দ্রুতই ইজারাদারদের সাথে কথা বলে লিস্ট করে এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন।’

এদিকে, নারায়ণগঞ্জে জনদুর্ভোগের অন্যতম একটি হলো, জনসংখ্যার বিপরীতে নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগে পড়ছেন নগরবাসী। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন আছে ১৪টি পাবলিক টয়লেট। এরমধ্যে আছে, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন গণশৌচাগার, খানপুর ধর্মতলা গণশৌচাগার, ২নং রেলগেইট গণশৌচাগার, আধুনিক কাঁচাবাজার গণশৌচাগার, খানপুর হাসপাতাল সংলগ্ন গণশৌচাগার, গাজীগঞ্জ গুদারাঘাট সংলগ্ন গণশৌচাগার, বংশাল রোড গণশৌচাগার, মন্ডলপাড়াপুল সংলগ্ন গণশৌচাগার, পাইকপাড়া বড় কবরস্থান সংলগ্ন গণশৌচাগার, পাইকপাড়া ছোট কবরস্থান সংলগ্ন গণশৌচাগার, জীমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়াম সংলগ্ন গণশৌচাগার, চাষাঢ়া হকার্স মার্কেটের ভিতরে গণশৌচাগার, নবীগঞ্জ বাজার গণশৌচাগার ও ডি আই টি মার্কেটের পিছনের গণশৌচাগার।

নগরীতে রাস্তায় বের হয়ে কর্মজীবী মানুষরা প্রতিনিয়তই পড়েন টয়লেট বিড়ম্বনায়। কারণ পর্যাপ্ত টয়লেট নেই, যা আছে সেগুলোয় দুর্গন্ধ, নোংরা প্যান, মেঝেতে জমে থাকে পানি, দরজা ভাঙা, পানির কল ভাঙ্গা, নেই পর্যাপ্ত নারীদের নিরাপদ ব্যবস্থা। অধিকাংশ প্রবেশমুখের সামনে টয়লেট পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন পুরুষ। এসব কারণে বেশির ভাগ নারীই পাবলিক টয়লেট এড়িয়ে চলেন। কোথাও আবার ইজারাদারদের মদতে পাবলিক টয়লেটের বারান্দায় দোকান বাসানো হয়েছে। ফলে রাস্তার পাশে, গাছের আড়ালে, এমনকি ফুটপাতেই টয়লেটের কাজ সেরে নিচ্ছেন অনেকে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-বালাই, নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্য।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চাষাঢ়া শহীদ মিনারের উত্তরপাশে পাবলিক টয়লেটটিতে নারী ও পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা বাথরুম। পুরুষদের জন্য ব্যবহৃত টয়লেটে নষ্ট রয়েছে পানির কল, ফ্ল্যাশ। একই অবস্থা নারীদের জন্য ব্যবহৃত টয়লেটটিতেও। সবমিলিয়ে সেখানে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ফলে নারী কিংবা পুরুষ সবাইকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী, প্রবীনদের জন্য সেই হাই কমোডের ব্যবস্থা। এছাড়া নগরীর অন্যান্য পাবলিক টয়লেট গুলোর সামনে বখাটেদের আনাগুনা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হওয়ায়, অধিকাংশ নারীরা এড়িয়ে চলে। কোন কোন পাবলিক টয়লেটের সামনে মাদক সেবন করতে দেখা যায়।

এছাড়াও কোনো কোনো পাবলিক টয়লেটে পাত্র থাকলেও নেই পানি। কোথাও ড্রাম ভর্তি করে রাখা রয়েছে পানি। বাথরুম থেকে পাত্র এনে বাইরে থাকা ড্রাম থেকে নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন নারীরা। আবার কোথাও একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী পাবলিক টয়লেট। ভাঙা দরজা, দরজা থাকলে ছিটকানি নেই। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট প্যান, এ ধরনের বাথরুম কোনোভাবেই ব্যবহারযোগ্য নয়। অন্যদিকে এমন সব দুগর্ন্ধময় পাবলিক টয়লেটে প্রসাব করার জন্য ৫টাকা ও পায়খানার জন্য ১০টা করে রাখা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, প্রচন্ড বেগ পাওয়ায় পাবলিক টয়লেটে গিয়েছিলাম। ঢোকার শুরুতেই প্রচন্ড পরিমানের দুর্গন্ধ। তবুও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছে। ভেতরে যাওয়ার পর খুব ইনসিকিউর ছিলাম। কারণ দরজার কোন ছিটকিরি ছিলো না। এমন সার্ভিস দেয়ার পরও ৫টাকা নেয় কিভাবে। এটা আসলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনা উচিৎ।

নাকে রোমাল দিয়ে অপেক্ষা করছেন অনিক হোসেন। টয়লেটের ভেতরে তার স্ত্রী বৃদ্ধ মাকে নিয়ে গেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জানান, এতো উন্নত মানের একটা শহরে ভালো পরিস্কার পরিছন্ন পাবলিক টয়লেট নেই। প্রতিনিয়ত সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দারা ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাঙ্খিত নাগরিক অধিকার আমরা পাচ্ছি। একটা সাধারণ পাবলিক টয়েলেটের সেবা দিতে পারে না সিটি কর্পোরেশন। তাহলে তাদের টেক্স দিয়ে কি লাভ আমাদের। তারা তো নাগরিক সেবাই নিশ্চিত করতে পারছে না।

অনিক হোসেন কথা গুলো বলতে বলতে এমন সময় স্ত্রী চলে আসে মাকে নিয়ে। তারাতাড়ি রিক্সা নেয়ার জন্য বলেন। স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আম্মার হাটুতে ও কোমরে সমস্যা। তিনি বাসায় নামাজ পড়ে চেয়ারে বসে। আজকে আম্মাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিলাম। বাসায় চলে যাওয়ার রাস্তায় হঠাৎ প্রশাব করার চাপ দেয়। উপায় না পেয়ে চাষাঢ়া পাবলিক টয়লেটে নিয়ে গেছিলাম। ইশ, কি দুর্ধন্ধ। তার উপর কোন হাই কমোড নেই। অথচ টাকা কিন্তু ঠিকঠাক রাখতেছে। লো কমোডে বসতে গিয়ে কাপড়ে ময়লা লেগে গেছে। এখন তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে গোসল করতে হবে।

মো. আল মেহেদী নামে এক যুবক অভিযোগ করে বলেন, এক হাত দিয়ে নাক ধরে আরেক হাতের সাহায্যে দাঁড়িয়ে প্রসাব করতে হয়েছে। মাস্ক পড়েছিলাম মাস্কের ভেতর দিয়ে গন্ধ নাকে লেগে যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্রাব দীর্ঘসময় আটকে রাখার কারণে কিডনিতে দুই ধরনের সমস্যা হতে পারে। এমনকি অপরিচ্ছন্ন টয়লেট থেকে রোগ-বালাই ছড়াতে পারে। তাই এগুলো অবশ্যই পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে। এছাড়া পাম্প, মার্কেট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা কোনো একটি ভবনের নিচতলায় পাবলিক টয়লেট করা যেতে পারে। এতে টয়লেটের সংখ্যাও বাড়বে, পাশাপাশি নগরবাসীর ভোগান্তিও অনেকটা লাঘব হবে।

নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া পাবলিক টয়লেটের ইজারাদার মো. আসাদুজ্জামান লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, কলভাঙ্গাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি। তারা কখনোই আসে না। যখন ইজারা দেয় তখনই তাদের দেখা মিলে এছাড়া তাদের দেখা যায় না। তারা বলে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ গুলো করার জন্য। আমাদের টয়লেটের আসে পাশে খাবারের দোকান আছে। যদিও এটা থাকার কথা না, কারণ আমাদের পাবলিক টয়লেটের জায়গায় বসাইছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন আমাদের বলেছে, তোমাদের জায়গা তোমরা উঠায় নেও। আমাদের টাংকি পরিস্কার করার কোন উপায় নাই। কিছু লোক আছে টাকা চাইলে আমাদের স্টাফদের মারতে আসে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে অনেক অসুস্থ রোগী আসে এখানে একটা হাই কমোড লাগে। আজকেও একটা এপ্লিকেশন জমা দিয়ে আসলাম। কিন্তু ওইটা কাগজের মতোই থাকবে। আমরা চাই আমাদের টয়লেট পরিস্কার থাকুক। প্রচুর টাকা ইজারা দেই, কিন্তু সিটি কর্পোরেশন আমাদের সেটা দেয়না। নারীদের দরজা ভাঙ্গা সেটা ঠিক করা হয় না। নারীরা পুরুষ টয়লেটের পাশ দিয়ে যায়। আমরা চাই সিটি কর্পোরেশন এসে দেখুক।

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আন্ডারে ১৪টি পাবলিক টয়লেট আছে। যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের জনসংখ্যা বেড়েছে, মার্কেটের সংখ্যা বেড়েছে। সেই বিবেচনায় ১৪টা পর্যাপ্ত না। আমিও মনে করি বৃদ্ধি করা উচিৎ। আমি প্রশাসক স্যারের সাথে কথা বলবো এই বিষয়ে। নতুন পাবলিক টয়লেট স্থাপন করার বিষয়ে স্থান নির্বাচন করার একটা বিষয় আছে। হতে পারে কোন প্রাইভেট প্রপাটি। আমরা সেখাবে ন্যাগসিয়েট করে সিদ্ধান্ত নিবো। সিটি কর্পোরেশনের জায়গা পেলে আমাদের জন্য সহজ হবে।

তিনি আরও বলেন, অনেক মার্কেটে নারীদের জন্য ভালো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। আমরা এ বিষয়ে মার্কেট মালিকদের সাথে কথা বলবো। আমরা ২জনকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব দিয়েছি সার্ভে করার জন্য। এটাকে আপডেট করার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহন করবো। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ শেখ রাসেল পার্কে একটা টয়লেট আছে হয়তো অনেকে জানেনা। আমরা পাবলিকের জন্য একটা স্থান নির্বাচন করে টয়লেট ব্যবস্থা করবো।

RSS
Follow by Email