- Details
-
Published on Thursday, 04 October 2018 20:49
ব্লু ব্লাড ও বাংলাদেশ
এ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম। বাংলাদেশের পূর্ব ইতিহাস অনেক নির্মম। যারাই রাজ্য শাসন করেছে কেহই নিয়তির আক্রোশ থেকে রক্ষা পায় নাই। অন্যদিকে “প্রকৃতির” তমাল দৌরাত্বের সাথে যুদ্ধ করেই এ জাতিকে টিকে থাকতে হচ্ছে। জলোশ্বাস, টর্নেডো, সুনামি, ঝড়-তুফান, বন্যা খড়ার পাশা-পাশি রয়েছে নদী ভাঙ্গন, সকালে যে আমির ছিল, ফকির হয়ে যায় সন্ধ্যা বেলা। র্দুভিক্ষের পাশাপাশি রিলিফ চুরি, টেন্ডারবাজীর পাশাপাশি রডের বিনিময়ে বাঁশ দিয়ে মফস্বল এলাকায় সরকারী অফিস/হাসপাতাল নির্মাণ, সন্তানকে হত্যা করে নিজে আতœহত্যা (এ প্রবনতা পূর্বের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে) প্রভৃতি প্রভৃতি ঘটনাকে হার মানিয়ে দেয় যখন চোখের সামনে দেখা যায় মিথ্যার নিকট জাতি পরাজিত হয়ে যাচ্ছে। হিটলারের প্রচার কর্মকর্তা গোয়েবলস্ মিথ্যাকে সত্যে পরিনত করার একটি দুষ্টক্ষত হিসাবে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিচিত। বর্তমানে মিথ্যাকে যে ভাবে সত্যে পরিনত করা হচ্ছে তাতে গোয়েবলস্ বেচে থাকলে আমাদের দেশের বুদ্দিজীবি বা কর্তা ব্যক্তিদের নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করতো।
“জবাবদিহিতা” নামক শব্দটি মনে হয় অভিধান থেকে উঠে যাবে। কারণ যে যে দায়িত্বেই থাকুক না কেন, হউক সাংবিধানিক বা নি¤œ পর্যায়ের সকলেই যেন এখন জবাবদিহিতার উর্দ্ধে। প্রজাতন্ত্রের যারা কর্মচারী বা কর্মকর্তা বা রাষ্ট্রপতি থেকে চৌকিদার পর্যন্ত যারা শুধুমাত্র জনগণের অর্থে কেবল লালিত পালিত নহে বরং সীমাহীন সূখ স্বাচ্ছন্ধ ভোগ করার পরও শুধুমাত্র নিয়োগকর্তার সন্তোষ্টি লাভের জন্য মিথ্যাকে সত্যে এবং সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দিয়ে র্নিদিধায় জনগণকে বঞ্চিত করছে ন্যায্য অধিকার থেকে।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় “তেলের বাটী” যেন একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠী। বিচার ব্যবস্থা তো বটেই বরং কর্তাখুশী তো সব খুশী এ বিবেচনায়ই চলছে প্রশাসন, বিচার ও সার্বিক ব্যবস্থা। বৃটিশ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্লু ব্লাড বলতে একটা সমাজ রয়েছে যাদের জন্য আইন ও আইনের শাসন অনেক শিথীল থাকে। বাংলাদেশেও একটি ব্লু ব্লাড সৃষ্টি হয়েছে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে। ব্লু ব্লাডের প্রতিনিধি ও রক্ত কনিকা ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী, যারা ব্যবসা, বানিজ্য, ঠিকাধারী, সর্দারী, মাতব্বরী সবই নিয়ন্ত্রণ করে এবং যাদের সেবা দাস হিসাবে সদা প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ ও প্রশাসন। ব্লাু ব্লাডেরা যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেহেতু সুবিধা সন্ধানী ও সুবিধাভোগীরা তাদের পক্ষেই হাত তালি দিচ্ছে, যোগান দিচ্ছে সমস্ত শক্তি এবং লুটে খাচ্ছে সাধারণ জনগণের আহার, বিপদগ্রস্থ হচ্ছে তারা যারা বিবেকের তাড়নায় বোল পাল্টিয়ে ব্লু ব্লাডের পদতলে নিজেকে আতœহুতি দিতে পারে নাই।
বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের বেতন ভাতা চলে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে, কিন্তু তারা ব্লু ব্লাডের সেবা দাসে পরিনত হয়েছে। অথচ সংবিধান বলছে যে, [অনুচ্ছেদ ২১(২)] “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” অথচ নি¤œ বর্ণিত ঘটনা থেকেই উপলব্দি করা যাবে জনগণের বেতনভুক্ত আমলাতন্ত্র দল মত নির্বিশেষে জনগণকে কতটুকু “সেবা” দিয়ে যাচ্ছে? ঘটনাটি হলো একদিন (২০১৮ ইং জানুয়ারি মাস) সুপ্রীম কোর্টের একজন সুনাম ধন্য ব্যারিষ্টার গাজীপুর জেলার সাভারে গিয়েছিলেন তার একটি ব্যক্তিগত কাজে। হঠাৎ একটি ট্রাক উল্টো পথে এসে গাড়ীটিকে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ায় তিনি নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট শরনাপন্ন হলে ও.সি সাহেব ব্যবহারটা এমন করল যে, মামলা নেয়া তো দূরের কথা ব্যারিষ্টার সাহেবকে ও.সি সাহেব পাত্তা না দিয়ে পাল্টা তার (ব্যারিষ্টারের) দোষ খুজতে থাকেন। ব্যর্থ মন নিয়ে পরের দিন ব্যারিষ্টার সাহেব শরনাপন্ন হলেন এক দূর সর্ম্পকীয় মামার নিকট যিনি পুলিশের একজন ডি.আই.জি (পুলিশের উপ-মহা পরিদর্শক)। ডি.আই.জি ফোন করে ব্যারিষ্টার সাহেবকে সহযোগীতা করার জন্য ও.সি’কে বলে দিলে ব্যারিষ্টার সাহেব পরের দিন থানায় পৌঁছা মাত্র ও.সি সাহেব এগিয়ে এসে ব্যারিষ্টার সাহেবকে বলেন যে, “আপনি তো আমার মামা লাগেন, এখন বলেন আপনার জন্য আমি কি কি করতে পারি?” তখন ও.সি ট্রাক ড্রাইভার ও মালিককে ডেকে এনে নগদ ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিলেন। ফলে ব্যারিষ্টার সাহেবকে মামলা করতে হলো না, কোর্টে যেতে হলো না, নগদ নগদেই বিচার টা পেয়ে গেলেন, শুধু মাত্র ব্লু ব্লাডের (ডি.আই.জি) একটি টেলিফোনের কারণে। ভাগ্যহত এই জাতির, যার কোন ব্লু ব্লাডের রেফারেন্স নাই সে এখন সর্বহারা, মার খেয়ে বিচার পাবে না, অথচ রেফারেন্স থাকলে খুনীও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবে, নিজে আতœতৃপ্তি লাভ করবে, অথচ খুনিকে খুনী বলা যাবে না, এটাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।
বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলা হয় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই। এ জন্য দায়ী কে? বিচারকরা নিজেই যদি নিজের মেরুদন্ড সোজা রাখতে না পারেন তবে আইন করে তাকে কতটুকু সোজা রাখা যাবে? দেশব্যাপী এখন সরকার কর্তৃক পুলিশকে বাদী করে গায়েবী মোকদ্দমা হচ্ছে। গায়েবী মোকদ্দমা অর্থাৎ যেখানে কোন ঘটনা ঘটে নাই, মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী সাজিয়ে প্রতি থানায় প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে যেখানে মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এমন কেহই গায়েবী মামলা অর্থাৎ গায়েবী গজব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। জাতীয় পত্রিকান্তরে ০৩/১০/২০১৮ ইং তারিখে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় যে, সেপ্টেম্বর/২০১৮ মাসে দেশব্যাপী গায়েবী মামলার সংখ্যা ৪,০৯৬ যার মধ্যে এজাহার নামীয় আসামী ৮৪,৫৩৫ জন, অজ্ঞাত রয়েছে ২৭,৩০৭৫ জন। দন্ডবিধির ১৭৭ ধারা থেকে ২২১ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা মামলা, মিথ্যা স্বাক্ষ্য প্রদান, মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান প্রভৃতি প্রভৃতি অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান থাকা স্বত্বেও পুলিশ জেনে শুনে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কি ভাবে মিথ্যা ও মিথ্যা গায়েবী মামলা সৃজন করছে? সরকারের আমলা বা পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব কি মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করা? পুলিশ কি জবাবদিহিতার উর্দ্ধে?